একজন সাংবাদিকের যত ধরনের গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তার সবকয়টি নিয়েই এই অসাধারণ মানুষটির জন্ম। ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদের জহুর হোসেন ও অবজারভারের আব্দুস সালাম একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন আমাদের সাংবাদিক জগেক। আজকের বাংলাদেশের প্রথিতযশা প্রায় সকল সম্পাদক তাঁদেরই হাত ধরে সাংবাদিকতা শুরু করেছেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতি বছর পারিবারিকভাবে জনাব আব্দুস সালামের মৃত্যু ও জন্ম দিবস পালন করা হয়। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে বক্তারা অনেক প্রতিশ্রুতির কথা বলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সরণি আব্দুস সালাম রাখার দাবি অনেক দিনের, কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি ২০১২ সালে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেন আবদুস সালামের জন্মস্থানের একটি সড়কের নাম 'মরহুম আব্দুস সালাম সড়ক' করবেন। কিন্তু আজও হয়নি।
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুস সালাম ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর মুন্সী বাড়িতে ১৯১০ সালের ২রা আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা দুলা মিয়া মুন্সী। আব্দুস সালাম ছাত্রজীবনে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম স্থান পান। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আই, এস, সি পরীক্ষায় মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থান লাভ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এরপর ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম হয়ে টনি মেমোরিয়াল স্বর্ণ পদক পান। অল্প কিছুদিন ফেনী কলেজে অধ্যাপনার পরে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি সরকারি আয়কর ও অডিট বিভাগে ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি ডেপুটি একাউন্টেন্ট জেনারেল ছিলেন। কিন্তু বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানীদের বৈষম্যের কারণে তিনি সরকারি লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির এক সপ্তাহ আগে তাঁর এক সম্পাদকীয়কে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে নূরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকার সালামকে কারারুদ্ধ করেন এবং ইংরেজি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ দু'বছর তাকে এখানে-সেখানে ছোটখাট চাকরি করে সংসার চালাতে হয়। এর পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। অবজারভার পুনরায় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশনা শুরু করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়। আব্দুস সালাম আইউব খানের আত্মজীবনী Friends, not Masters এর বিরূপ সমালোচনা করায় তাঁর পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়। অবাঙালিদের স্বার্থের মুখপত্র 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকার প্রেস দুর্ঘটনাক্রমে আগুনে পুড়ে গেলে আব্দুস সালামকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তবে গোটা পাকিস্তানেই আব্দুস সালাম বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য একটি সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁকে পাকিস্তান কাউন্সিল অব নিউজ পেপার এডিটরস-এর সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবেরও আজীবন সদস্য পদ লাভ করেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ঢাকার সব দৈনিকের সম্পাদক পরিবর্তন হলেও আব্দুস সালাম স্বপদে থেকে যান। কিন্তু নতুন সরকারকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে 'দি সুপ্রীম টেস্ট' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখায় তাঁকে সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর পরেও তিনি অধুনালুপ্ত 'বাংলাদেশ টাইমস' পত্রিকায় কলাম ও সম্পাদকীয় লিখতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে জিয়াউর রহমান তাঁর অনুরোধে প্রেস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং আব্দুস সালাম হন তার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতেই তিনি শেষ শক্তি ব্যয় করেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম একুশে পদক প্রবর্তন হলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর মত আব্দুস সালামও এই পদকে ভূষিত হন।
তাঁর ছেলে আহমদ শফি বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বড় জামাতা বিশিষ্ট কলামিস্ট এ বি এম মুসা। আব্দুস সালামের সংস্পর্শে যারাই ছিলেন তারাই অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন তাঁর ব্যক্তিত্ব। অগাধ পাণ্ডিত্য, দ্যুতিময় চোখ, আন্তরিক স্পর্শ, নির্ভীক হূদয়, অপরকে সাহায্য করার উদার মানসিকতা, নির্লোভতা ও দার্শনিকতা। তাঁর বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও জার্মান ও ফরাসি ভাষায় ব্যাপক দখল ছিল। রাজনীতি, দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, হিসাব বিজ্ঞান, দর্শন, জুরিসপ্রুডেনট সহ সব বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। দার্শনিক বার্নার্ড রাসেল ও তত্কালীন জার্মানির চ্যান্সেলর ওইলি ব্রানডট-এর সাথে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত পত্রালাপ হতো। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুর উপর তিনি 'আইডল থটস' নামে কলাম লিখে প্রশংসিত হয়েছেন।