বিত্ত-বৈভবকে কম গুরুত্ব দিয়ে সত্যিকারের সুখ-খুঁজে বেড়াচ্ছে ভুটান। অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে বাকি বিশ্ব যেখানে সুখি না অসুখি প্রশ্নটিকেই অবান্তর ভাবছে, সে জায়গায় সুখি থাকার প্রশ্নে 'হ্যাঁ' বা 'না' এই দুটি উত্তরের মাঝে হ্যাঁ-এর ঘরে টিক দেয়ার চেষ্টা করছে ভুটান। বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী জিগমে ওয়াই থিনলে দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলছিলেন, 'লোভ, মানুষের অফুরন্ত লোভ।' তিনি আরো জানান, এই মুহূর্তে ভুটানের যা প্রয়োজন, তা হল—পরিবর্তন। তিনি আরো জানান, দেশটির সকল চিন্তা এখন জাতীয় সুখ (Gross National Happiness, সংক্ষেপে GNH) কেন্দ্রিক। ১৯৭০-এর দশকে জিডিপি'র (মোট জাতীয় আয়ের) পরিবর্তে জিএনএইচ ধারণাই ছিলো সাবেক রাজা জিগমে সিংঘে ওয়াংচুকের কর্মের প্রেরণা। এখন আবার সে পথেই হাঁটছে তারা।
দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে যে দর্শন, সেই দর্মণকে আরো পরিমার্জিত ও উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে এখন ভুটানিরা। এটিকেই তারা মনে করছে নতুন এক রাষ্ট্রবিজ্ঞান। মোট জাতীয় উত্পাদনের পরিবর্তে মোট জাতীয় সুখের দর্শন সরকারি নীতিতে পরিণত হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন পুরো বিশ্বের জন্য এটি প্রযোজ্য হতে পারো— এমনই মনে করেন ভুটানের তথ্য ও যোগাযোগ সচিব কিনলে দর্জি। বিশ্বের চলমান সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, দেখুন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের প্রয়াস ভেস্তে গেছে। শিল্পোন্নত সমাজগুলোও ভাবতে শুরু করেছে যে, জিডিপি হচ্ছে একটি ভাঙ্গা প্রতিশ্রুতি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, যে কোনো দেশের সরকারের লক্ষ্য তাহলে কী হওয়া উচিত? জিগমে থিনলের বক্তব্য, 'আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার আধুনিক রূপই আমাদের লক্ষ্য, যার মূল বক্তব্য হলো, সার্বিক জাতীয় সুখলাভের চেষ্টা ।'
একটা পরীক্ষা- নিরীক্ষার মধ্যে আরেকটা পরীক্ষা- নিরীক্ষা দিয়ে ভুটানে সুখের অর্থনীতির কার্যক্রম সূচিত হয়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জনপ্রিয় রাজার পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দেশটিতে চার বছরেরও বেশি সময় আগে। এ প্রসঙ্গে কিনলে দর্জির মন্তব্য, এই পরিবর্তন মোট জাতীয় সুখ কার্যক্রম বাস্তবায়নেরই অংশ। গণতন্ত্র এবং জিএনএইচ ভালো অনুসরণ সৃষ্টি করতে পারে। দুটিই বক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। সুখ হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভের চেষ্টা। আর গণতন্ত্র হচ্ছে ব্যক্তির ক্ষমতায়ন। ক্ষমতা থেকে একতরফাভাবে পিছু হটার ঘটনা পৃথিবীর রাজাদের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বিক্রমে সিংহে ওয়াংচুক এ কাজটি করেছিলেন প্রজাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে। অবশ্য ক্ষমতা ছেড়েছিলেন তারই ছেলে জিগমে খিসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের কাছে। কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ছাড়াই নামগিয়েল রাজমুকুট পড়েন ২০০৮ সালের অক্টোবরে।
ভুটান সমভবত একটি সহজ জায়গা, যার অর্থনৈতিক নিয়মাবলী লিখে ফেলা যায় ক্ষীপ্রগতিতে। হিমালয় পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র এ দেশটির বিমানবন্দর মাত্র একটি। মোট বাণিজ্যিক বিমানের সংখ্যা দুই। আয়তন কম হলেও দেশের পূর্ব প্রান্তের লোকজনের পশ্চিম প্রান্তে যেতে হলে পাহাড়ি রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে হয় চারদিন। চীন, ভারত ও নেপালের দ্বারা ঘিরে থাকা এ দেশটির লোকসংখ্যা ১১ লাখের বেশি নয়। জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোর ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণই দেশটির এখনকার কাজ। ভুটানে সিগারেট নিষিদ্ধ। টেলিভিশন কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। পোশাক ও স্থাপত্যশৈলীর ক্ষেত্রে অনুমোদিত আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। রাজধানী থিম্ফুতেও স্টপলাইট নেই। কর্তব্য পালন করেন মাত্র একজন ট্রাফিক অফিসার।
ভুটান যে নীতি গ্রহণ করেছে, সে নীতি যদি বাকি বিশ্বও গ্রহণ করে, তাহলে প্রথমেই সংজ্ঞা ও মান নির্ধারণের জন্য একটি নকশা অংকন করতে হবে, যার দ্বারা সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে কিনলে দর্জির অভিমত, 'একদিন ভুটান গর্বসহকারে বলবে যে, জিএনএইচ দিয়ে আজ আমরা এই অবস্থানে।' উন্নত বিশ্ব, ব্যাংক ও বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ যখন জিজ্ঞেস করবে, তোমরা সুখ পরিমাপ করবে কীভাবে, দর্জি তখন জবাব দেবেন, অর্থনীতির বড় খেলুড়েদের প্রতিক্রিয়া দেখেই আমরা তা বুঝতে পরবো।
ভালো থাকার জটিল এক মডেল আবিষ্কার করেছে তারা। এতে আছে চারটি স্তম্ভ। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও ভালো ব্যবস্থাপনা। এই চার স্তম্ভ আবার নয়টি উপ-স্তম্ভে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে, মানসিকভাবে ভালো থাকা না-থাকা, প্রতিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জীবনমান, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়গত অত্যাবশকতা এবং ভালো পরিচালনা। এর প্রত্যেকটির আছে নিজস্ব মূল্য নির্ণয়কৃত অথবা মূল্য নির্ণয়হীন জিএনএইচ সূচি। সব কিছু বিশ্লেষিত হয় ৭২টি সুখ-নির্দেশক চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ মানসিক তৃপ্তির প্রসঙ্গে আসা যাক। মানসিক স্বস্তি বিষয়টির অধীনে নির্দেশকগুলো হলো—প্রার্থনা ও ধ্যানের পরিমাণ এবং স্বার্থপরতার অনুভূতি, ঈর্ষা, প্রশান্তি, সমবেদনা, ঔদার্য ও হতাশা অধিকন্তু আত্মহত্যার চিন্তা-ভাবনা।
আগামী বছর বিশ্বনেতাদের আমন্ত্রণ জানাবে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্বচক্ষে দেখার জন্য। এ কথা ঠিক, দেখানোর মতো অনেক কিছু রয়েছে তাদের। সংবিধানে উল্লেখ আছে, দেশের মোট ভূমির কমপক্ষে ৬০ শতাংশতে বনাঞ্চল থাকতে হবে— এটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তারা। চালু হয়েছে শতভাগ জৈবকৃষি। দুই প্রজন্ম ব্যবধানে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশের ৯৯ ভাগ শিশুই গ্রহণ করছে প্রাথমিক শিক্ষা। গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন নাই বললেই চলে। নারীর ক্ষমতায়ন ও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখি উদ্যোগ। স্থানীয় অর্থনীতি ও শক্তিশালী কমিউনিটি নেটওয়ার্ক পাচ্ছে সরকারি সহযোগিতা।
—ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন অনুসরণে