টিএসসিতে গান চলছে। গানকে কেন্দ্র করে দর্শক, আশপাশের মানুষ ও চলমান গাড়ি থেকে টাকা সংগ্রহ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। সাত দিন ধরে টাকা সংগ্রহ করছেন তারা। নিজেদের জন্য নয়। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় থাকা বন্ধুর মায়ের চিকিত্সার জন্য। শেষ পর্যন্ত মাকে বাঁচানো যায়নি। এমনিভাবে বেদনার্ত বর্ণনা দেন সেই তরুণদলের একজন রিফাত বিন সালাম।
সমাজের ক'জন মানুষ হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ নিয়ে ভাবে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম রিফাত বিন সালাম। চাকরিজীবী হয়েও মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে ছুটে বেড়ান অক্লান্ত। শুধু তা-ই না, ভিনদেশেও পেয়েছেন এ কাজের জন্য স্বীকৃতি ও সম্মান। এ ছাড়া বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার ব্রাহ্মণদি গ্রামের রিফাত বর্তমানে ঢাকায় সপরিবারে বাস করেন।
শুরু যেভাবে :রিফাত বলেন, বন্ধুর মাকে হারানোর কষ্টটা মনে ভীষণভাবে দাগ কাটে। মূলত এখান থেকেই দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করার ভাবনা শুরু। প্রথমে বন্ধুসহ 'ইকুয়েল টু' নামের একটি সংঘটন করি। কাজ হলো গরিব শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ সংগ্রহ ও বিতরণ। যেমন—পেন্সিল, কলম, বই-খাতা ইত্যাদি। সহযোগিতার জন্য ফেসবুক ও পরিচিতজনকে আহ্বান জানাই। নিরাশ করেনি তারা।
ভিনদেশে স্বীকৃতি :পূর্ব পরিচিত ভারতীয় একজন বন্ধু থেকে সেলোভেনিয়ার সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান 'চ্যালেঞ্জ ফিউচারের' খোঁজ পাই। তাদের হয়ে এ দেশের প্রতিনিধি হয়ে কাজের আগ্রহ দেখে আমাকে নির্বাচিত করে। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সহযোগিতা করে না। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভাবনাগুলো জানায় ও সে অনুযায়ী কাজের কথা বলে। ইউথ ফর ইউথ নামে কাজের মাধ্যমে বিভিন্নজন হতে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে গরিব শীতার্তদের দিই। কাজের বিবেচনায় ২০১২ সালের মার্চে সেলোভেনিয়ায় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিল্ড স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ১০ দিনব্যাপী কর্মশালায় আমার ডাক পড়ে। মোট ৪৫টি দেশের প্রতিনিধিকে এ কর্মশালায় সুযোগ দেওয়া হয়। আমিসহ ১১ জনকে বিনা খরচে এ সুযোগ দেওয়া হয়। কর্মশালার মূল বিষয় ছিল সংশ্লিষ্ট দেশের সমস্যা ও সমাধানের উপায় এবং সবার ভাবনাগুলো সবার সঙ্গে আলোচনা করা।
কর্মশালায় একদিন উপস্থিত হন সেলোভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট। সবাই ছবি তোলা, পরিচিত হওয়া নিয়ে ব্যস্ত। সুযোগ না পেয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছিলাম। এক প্রসঙ্গে তিনি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। নিজের মনকে আর আটকাতে পারলাম না। হাত উঁচু করে একটু ভিড় ঠেলে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গর্ব করে বললাম, আমি ড. ইউনূসকে জানি ও আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তিনিও আমাকে সানন্দে অভিন্দন জানান। কি যে এক অনুভূতি!
যা পেলাম :প্রশিক্ষণের এক সন্ধ্যায় ছিল অংশগ্রহণকারীদের নিজ দেশের উপস্থাপনা ও খাবার পরিবেশন করা। উপস্থাপনায় অনেক গর্ব নিয়ে বলেছি বাংলাদেশিরা পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। ক্রিকেটপাগল এ দেশ ও নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণসহ আরও সফলতা কথা। করতালির যে আওয়াজ শুনেছি, এখনও কানে বাজে। স্বীকৃতি হিসেবে তিন দেশের প্রতিনিধিসহ আমাকে দেয় বিশেষ সম্মাননা। ভিনদেশে নিজের দেশকে নিয়ে গর্ব করার মধ্যে রয়েছে অসাধারণ এক অনুভূতি। আরও কিছু বিষয় যা কখনও ভোলার নয়। তার মধ্যে ভারতীয় প্রতিনিধি অপুর্ভার কথা। সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বিষয়ে ছোটখাটো বাগ্যুদ্ধ হয় তার সঙ্গে। পরে সে এককথায় মেনে নেয় সীমান্তে বিএসএফ যা করছে তা অন্যায়। পাকিস্তানের করাচি থেকে আসা ফয়সাল আমাকে দেখলে প্রায় বলত, 'তোমার দেশের মানুষ কি আমাদের অনেক ঘৃণা করে?' পরে সে নিজেই বলে, 'আমি, আমার পরিবার ও বন্ধুরা স্বীকার করি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা অন্যায় ও অমানবিক।' বিদায়েরর দিন আমার ডায়েরিতে ফয়সাল লিখল, 'আমাদের ঘৃণা করো না, ক্ষমা করে দিয়ো।' এ যেন আরেকটা যুদ্ধের বিজয় নিয়ে আমার স্বদেশ ফেরা।
আগামীর ভাবনা :আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে কটুক্তি করে। তবে মন খারাপ হয় না। কারণ এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই আমাদের এগিয়ে চলা। বর্তমান ও আগামীর ভাবনায় শুধু দরিদ্র মানুষগুলোকে ঘিরে। এ বিষয়ে সমাজের মানুষের প্রতি আহবান রইল তারাও যেন তার সাধ্যমতো সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন