‘...শেফালি বেগমের বাড়ি আব্দুল করিমের যাওয়া হয়নি। মাঝপথ থেকেই সে ফিরে আসে। এমনি এমনিই। কেন সে গিয়েছিল, কেনই বা ফিরে এল, আব্দুল করিম নিজেও জানে না। যেমন আমরা, ছোট রাস্তার মানুষরাও জানি না। কোনও শেফালি বেগম আমাদের আশ্চর্য ঠিকানা দিয়ে যায়। ময়মনসিংহ থেকে ফুলবাড়ি যাওয়ার। আমরা হঠাত্ একদিন গিয়েও, শেফালি বেগমের বাড়ি না খুঁজে ফিরে আসি। ক্যালা? এমনিই। ভূতের গলি আর আব্দুল করিমকে নিয়ে এই আশ্চর্য গল্পটা লিখেছেন বাংলাদেশের প্রয়াত লেখক শহীদুল জহির। ...আমাদের ছোট রাস্তার ভিতরে আজ এসে ঢুকে পড়ল শহীদুল জহিরের ভূতের গলি।’
সমকালীন কথাকার রবিশংকর বলের উপলব্ধ-উচ্চারণ এটি। ঠিক এভাবেই শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) কথাসাহিত্যের প্রথাসিদ্ধ পথকে দুমড়েমুচড়ে তাঁর অভূত ভূতের গলির সামনে এনে দাঁড় করান আমাদের। যে গলি চেতনবাস্তবের হাঁটাপথে আমাদের প্রতিদিন পার হতে হয় অথচ ঠুলিপড়া চোখে আমরা তাঁকে ঠিক চিনে উঠি না অথবা চিনে উঠতে চাই না।
বছর পঞ্চান্ন-র জীবনে গল্পগ্রন্থত্রয় ‘পারাপার’ (১৯৮৫), ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৯৯), ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪); চারটি উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ’(১৯৮৮), ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল ’(১৯৯৯), ‘মুখের দিকে দেখি ’(২০০৬), ‘আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু’(২০০৯)-সহ অগ্রন্থিত কিছু গল্প, অপ্রকাশিত উপন্যাসের খসড়া, দু-একটি কবিতা ছাড়াও এন্গুগি ওয়া থিওংগ’ও, হোর্হে লুই বোর্হেস, চিনুয়া আচেবে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মাও-সে-তুং ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অনুবাদেও তাঁকে ব্যাপৃত দেখি। আর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বেশ কিছু সাক্ষাত্কার-চিঠিপত্র ও দিনলিপি, জীবন ও শিল্পবাস্তবতা নিয়ে তাঁর ভিন্নতর ভাবনারেখা অঙ্কিত করে পাঠকের পটে।
জহির তাঁর শেষ উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘মুখের দিকে দেখি’; আমরাও দেখতে চাই শহীদুল জহিরের দিকে। তাঁর সৃষ্টি-রসায়ন অনুসন্ধানের পাশাপাশি বুঝে উঠতে চাই তাঁর উত্তরপ্রভাব।
চর্চার একদিক
শহীদুল জহিরের বন্ধু মোহাম্মদ আবদুর রশীদের ভাষ্য উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘মৃত্যু তাঁকে নতুন জন্ম দিয়েছে।’ অসময় মৃত্যুর অব্যবহিত পর লোক, শালুকসহ বেশ কিছু লিটলম্যাগ শহীদুল জহিরকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। বিশেষ করে তরুণ লেখকরা তাঁদের লেখায় জহিরকে যেভাবে মূল্যায়ন করেন তা তাঁর প্রবল উত্তরপ্রভাবের সংকেত রেখে যায়। কারণ প্রথাবাহী কথারাজ্যের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তিনি তো চিন্তা-ভাষা ও শৈলীতে সঞ্চার করেছেন আদ্যন্ত নতুনতার বোধ। পাঠক সমাবেশ ২০১০ সালে যে বিপুলায়তন ‘শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে তাতে বাংলা ভাষার নবীন-প্রবীণ লেখকবৃন্দ শহীদুল জহিরের অভিনতুন গদ্যশাসনকে ব্যাখ্যা করেন নিজস্ব বিবেচনাবলিতে।
প্রয়াত লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর একটি কথাসাহিত্য বিষয়ক পর্যালোচনা গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির’ (২০১১)। ‘শহীদুল জহিরের শেষ সংলাপ ও অন্যান্য বিবেচনা’ (২০১২) শীর্ষক বই লিখেছেন আর কে রনি। জহির নিজেই ‘আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস’ গল্পটিকে History of our cottage Industry নামে অনুবাদ করেছেন; তাঁর আরো কিছু লেখা কেউ কেউ অনুবাদে হাত দিয়েছেন। উচ্চতর একাডেমিক গবেষণায় শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্য বিষয় হচ্ছে কোনো কোনো গবেষকের।
লক্ষযোগ্য বিষয়, বেঁচে থাকতেই জহির দেখে গেছেন তাঁর রচনা নিয়ে তরুণ চলচ্চিত্র— নাট্যনির্মাতাদের বিশেষ আগ্রহ।
আমরা দেখছি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’-এর সিংহভাগ গল্পই এসেছে ফিল্ম ও মঞ্চের পর্দায়। তাঁর ‘এই সময়’ গল্প নিয়ে আশিক মোস্তফা নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র ‘ফুলকুমার’, একই গল্প নিয়ে ইকবাল খোরশেদও নাটক নির্মাণ করেছেন। ‘কাঁটা’ গল্প নিয়ে সরকারি অনুদানে টোকন ঠাকুর নির্মাণ করছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্প নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন; ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পকে নাটকে এনেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং দীপংকর দীপন, কাঁটা গল্প নিয়ে অনিমেষ আইচ টেলিফিল্ম বানিয়েছেন, শহীদুলের রচনাকর্মের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে অনিমেষের চলচ্চিত্র ‘না মানুষ, গল্প ‘চতুর্থ মাত্রা’ নিয়ে ছবি বানিয়েছেন নূরুল আলম আতিক, ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ নিয়ে নাটক নির্মাণ করেছেন জাহিন জামাল। আর শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এর প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা’ নিয়ে রেদোয়ান রনির নির্দেশনা ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর নাট্যরূপে নির্মিত হয়েছে নাটক ‘ফুল’। এ তালিকার বাইরেও নির্মীয়মাণ রয়েছে আরো কিছু নাটক-চলচ্চিত্র।
মঞ্চেও এসেছেন শহীদুল জহির। সমপ্রতি ‘আরশীনগর’ রেজা আরিফের নির্দেশনায় মঞ্চে এনেছে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’; এর আগে নাসিরউদ্দিন শেখের নির্দেশনায় দেশনাটক ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ অবলম্বনে মঞ্চে এনেছে নাটক ‘জন্মে জন্মান্তর’।
শহীদুল জহিরের গ্রন্থিত, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা, চিঠিপত্র, ডায়েরি, সাক্ষাত্কার, মূল্যায়ন, জীবনপঞ্জি এবং অ্যালবামসহ মোহাম্মদ আবদুর রশীদের সম্পাদনায় পাঠক সমাবেশ ২০১৩-তে প্রকাশ করে প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠার ‘শহীদুল জহির সমগ্র’।
জীবত্কালে ও মৃত্যু-উত্তর তিনি ভূষিত হয়েছেন তিনটি পুরস্কারে, তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধ করি তাঁর প্রতি পাঠকের উত্তরোত্তর সজীব আগ্রহ। তাঁর রচনা ও তাঁকে নিয়ে সম্পাদিত কাজগুলোর প্রতি পাঠকের বিপুল অভিনিবেশ প্রমাণ করে, জহির মুহুমুর্হু বেঁচে আছেন সচেতন পাঠকের বর্ধিষ্ণু পাঠপ্রবাহে। একজন লেখকের এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
এবং মিসরিডিং
শহীদুল জহিরের সঙ্গে অন্বয় তৈরিতে ব্যর্থ আমাদের সাহিত্যপাঠের সনাতনি গত্ ও বিবেচনা। তাই তাঁকে নিয়ে আয়োজিত কোনো সেমিনারে আমলা সভাপতির বক্তব্য-বিষয় হয় তিনি কত ভালো চাকুরে ছিলেন সেই কেচ্ছা; তাঁর লেখকসত্তা এই শ্রেণির কাছে নিতান্তই বাহবা-সূচক। আবার সাহিত্যের সিদ্ধিপ্রাপ্ত কোনো অধ্যাপক তাঁর উপন্যাসে সাজানো-গোছানো কাহিনিক্রম ও কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সমাপ্তির অনুপস্থিতিতে হাঁপিয়ে ওঠেন।
আখ্যানের শ্বাসমূলে প্রতিআখ্যানের সংস্থানে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে চলেন জহির তাঁকে টের পেতে শিল্পরুচির রীতিবদ্ধ স্পেস শুধু প্রসারণই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে আমূল পাল্টে দেয়াই অবিকল্প বোধ করি।
জাদুবাস্তব নয় অতিবাস্তব
বিশেষণপ্রবণ বাঙালি শহীদুল জহিরকে ‘জাদুবাস্তব লেখক’-এর ঘেরাটোপে আটকে ফেলেছে প্রায়। ফলত তাঁর লেখনরীতির করণকৌশলের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর স্পষ্ট-স্বচ্ছ চেতনালোক। অথচ নানান সাক্ষাত্কারে জহির বলেছেন, জাদুবাস্তব নয়, তিনি অতিবাস্তবের চর্চা করেছেন মাত্র। তাঁর মতে, ‘জাদুবাস্তবতা বাস্তবই, বাস্তবের একটা ভিন্ন তল মাত্র।’ অতিবাস্তব জাজ্বল্যের কারণেই আমরা দেখি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ কেবল নামকরণেই ‘রাজনীতি’ শব্দবন্ধধারী নয়, বরং ক্ষীণতনু এই আখ্যানে জহির প্রবল বিস্মরণের কালে শিল্পীর দ্রুতরেখ টানে ধারণ করে রাখেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর স্বপ্ন খান খান হয়ে যাওয়ার অর্ন্তগূঢ় বিবরণ।
এই উপন্যাসের কাহিনি ১৯৭১ আবার ২০১৪-রও। এই উপন্যাসের পটভূমি যেমন আরমানিটোলা, লক্ষ্মীবাজার, নয়াবাজার, সিদ্দিকবাজার, জিঞ্জিরা, পাটুয়াটুলি, নারিন্দা, ইংলিশ রোড, সোয়ারিঘাট, চক সার্কুলার রোড, চম্পাতলী, ভিক্টোরিয়া পার্ক, রায়সাবাজার, ওয়ারি, কলতাবাজার, মালিটোলার মতো পুরান ঢাকার অলি-গলি-তস্যগলি, পাড়া-মহল্লা তেমনি একই সঙ্গে গোটা বাংলাদেশই এর পটভূমি। কারণ স্থান ও কালের সীমাবদ্ধ পরিসরকে আলোচ্য আখ্যান সবেগে ছিন্ন করে। বাস্তব ও কল্পনার বিভাজক রেখাসকল গুঁড়িয়ে দেয়। এই উপন্যাস যুগপত্ স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন ছিনতাইয়ের বাস্তবতা।
একজন বদু মওলানার প্রতীকে এখানে রঙবেরঙের ঘাতক-দালালের চেহারা পরিষ্কার ভেসে ওঠে পাঠকের চোখের সামনে। বদু মওলানার মতো নিবেদিত রাজাকার কীভাবে একাত্তরের পর সাধারণ ক্ষমার বদৌলতে বীরদর্পে ফিরে আসে লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনে; এই উপন্যাস শুধু সে মর্মান্তিক দৃশ্যই আমাদের দেখায় না, একই সঙ্গে বদু মওলানার মতো রাজাকারদের জিঘাংসার শিকার নিহত মোমেনার মায়ের প্রতিবাদী অবয়বও স্পষ্ট করে। বদু মওলানাকে উদ্দেশ করে ‘থুক দেই, থুক দেই, থুই দেই মুখে’র মধ্য দিয়ে মোমেনার মা’র মতো লক্ষ শহীদ জননীর গণঘৃণাই যেন বর্ষিত হয়। এই আলোচনাকাল আমরা যেন ভুলে না যাই যে নব্বইয়ের দশক অর্থাত্ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র রচনাকাল ছিল বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের করালকাল। এবং এর কিছুকাল পরেই মোমেনার মার মতোই জাহানারা ইমাম নামের এক শহীদ জননী বদু মওলানার মতো স্বাধীনতার শত্রুদের বিচারের ডাক দেন।
মহত্ শিল্পী শহীদুল জহির দিব্যি ভবিষ্যত্ দেখেছেন। রাজাকারের মুখে থুতু নিক্ষেপের ছলে মোমেনার মা যেন প্রশ্নবিদ্ধ সাধারণ ক্ষমাকে প্রত্যাখ্যান করে এই ঘৃণ্য ঘাতকদের নিক্ষেপ করে দিলেন হাড় ও খুলির পাহাড় আর রক্তের নদী ভরা বাংলার জাগ্রত বিবেকের কাছে।
খণ্ড খণ্ড নানান বাস্তব বিদ্যুচ্চমকের মতো খেলে যায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র পাঠকের চেতনায়। এই যেমন অতীতের ঘাতক সমকালে এসে ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু নেই’ তত্ত্ব আউড়ে মিশে যায় রাজনীতির মূলস্রোতে; আর এর বিপরীতে রক্তস্নাত স্বদেশে এক শহীদ পরিবারের সদস্য জনৈক আবদুল মজিদকে তখন ভাবতে হয় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এ কেমন বাস্তবতা উপহার দিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারে কোনো তফাত থাকে না। তখন যুদ্ধাপরাধী বদু মওলানার দাপট দেখে ঘৃণায়-গ্লানিতে নিজ মহল্লা ছেড়ে আবদুল মজিদের পরিবারকে পালিয়ে যেতে হয়।
তবে এই পলায়নই শেষ কথা নয় কিংবা হেরে যাওয়া নয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনাকে বিস্মরণের বিরুদ্ধে লড়াইটা জারি থাকে। তাই রাজাকারদের হাতে নিহত মোমেনার হতভাগ্য ভাই আবদুল মজিদ তার মেয়ের নাম রাখে ‘মোমেনা’। যেন মোমেনাই রাজাকারদের হাতে ধ্বস্ত স্বদেশমাতার করুণ প্রতিকৃতি।
কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের জবানিতে জানা যাচ্ছে এই উপন্যাস সম্পর্কে জহির বলছেন ‘যখন উপন্যাসটি লিখছি তখন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা ভয়ংকরভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ছিলাম, আমি মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ংকর সময়টির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম, নাম নিয়ে কোনো কাব্য আর রস করবার মানসিকতা ছিল না।’
এই হচ্ছেন শহীদুল জহির যিনি প্রসাধিত প্রবঞ্চনায় নিতান্তই অনাগ্রহী। তিনি বরং শিল্পের জমিনে উদোম করে মেলে ধরেন রুক্ষ-করুণ অতিবাস্তব যা শেষত শিল্পকেই দেয় নতুন ঋদ্ধি।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’-তেও ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। ফিরে আসাই তো স্বাভাবিক। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে শহীদুল জহিরই তো বলেছেন, তিনি ‘নিত্য মুক্তিযুদ্ধময়’।
শহীদুল জহিরের নতুন জন্ম
সাহিত্য সম্পর্কিত ব্যাখ্যার অবভাসে নয়, বরং শহীদুল জহির নতুন করে আবিষ্কৃত হন ২০১৩-র ঐতিহাসিক শাহবাগ অভ্যুত্থানে।
আমরা মোটেও কাকতাল বলব না ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার’ উত্সর্গপত্রকে। এই উপন্যাস তিনি তুলে দিয়েছেন ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের হাতে’। প্রথম প্রকাশের পাক্কা পঁচিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধোত্তর এই প্রজন্মই তো তাঁর চরিত্র বদু মওলানার মতো রঙবেরঙের কাদের মোল্লাদের শনাক্ত করে ঘোষণা করে, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় এদের কোন ছাড় নেই।’ বিপন্ন বাস্তবের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তরুণ প্রজন্ম ঘোষণা দেয়, ‘ভুলি নাই, ভুলবো না কিছুই।’ যেন মনে করিয়ে দেয় শহিদ মোমেনাদের মাটিতে একটি রাজাকারেরও নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার নেই।
তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অলক্ষে যেন চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকেন শহীদুল জহির। আন্দোলনের স্থিরলক্ষ্য প্ল্যাকার্ড হাতে সমবেত প্রজন্মের উদ্দেশে যেন মিলান কুন্ডেরার মতো বলে ওঠেন তিনি, ‘আমার লেখালেখি মূলত বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’
মহল্লা যখন সদর হয়ে ওঠে
শহীদুল জহির শ্লোগানসত্যের বাইরে গিয়ে করেছেন চেতনার অর্ন্তদীপ্ত চর্চা। ঘটনা ও কালক্রমের যান্ত্রিক অনুসরণ না করে কী স্বভাবস্বাচ্ছন্দ্যে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্ কালসীমা চূর্ণ করে তিনি বলে চলেন তাঁর কথা! কথার পিঠে তাই জন্ম হয় অজস্র জরুরি প্রতিকথার।
ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠী উভয়েই তাদের অন্তর্চাপ-আকুলতা-আকাঙ্ক্ষা-পতন-উত্থানসহ জহিরে আসে তাঁর সৃজনশীলতার বিচিত্রবিধ মাত্রায়। এভাবে তিনি গুঁড়িয়ে দেন বাংলা গদ্যের গতানুগামী অবস্থান ও
গন্তব্য। মহল্লার গল্প শুনিয়ে চলেন শহীদুল জহির। এই মহল্লা আক্ষরিক ও প্রতীকার্থ-উভয়তই সমসত্য। মহল্লার আবডালে তিনি মানুষজীবনের আলো না-পড়া অঞ্চলে হানা দেন।
এভাবে বাস্তব-নেপথ্যে বহমান অতিবাস্তব মূর্ততা পায়, আমাদের সাহিত্যে এভাবে মহল্লাকে সদর করে তোলেন শহীদুল।
ভাষা নিয়ে ভাবনা
তাঁর গল্প-উপন্যাসে ভাষার যথাপ্রযুক্ত ব্যবহারে জহির এক অনন্য দৃষ্টান্তের নাম। তাই বুঝি ভাষা-সামপ্রদায়িকতা, ভাষা-রাজনীতি বিষয়েও সমান সচেতন তিনি। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পূর্বোক্ত আলাপে জহির বলেন, ‘ভাষাকে নিয়া আমাদের মানসে একটা সামপ্রদায়িক প্রসঙ্গ ছিল। এখনো না থাকার কারণ নাই। সামপ্রদায়িকতা আমাদের একটা বড় সমস্যা। আমাদের সতর্ক থাকা লাগবে। যা হোক, প্রথম কথা হচ্ছে ভাষার মুসলমানিকরণের কোনো অবকাশ নাই। আমাদের মান চলতি বাংলা ভাষাকে নালায়েক-বেয়াদব মনে হয় না, আমার মনে হয় ভাষাটা পটের বিবির মতো, রক্ত নাই, মাংস নাই, ঘাম এবং বীর্যের গন্ধ নাই, কথায় এবং সৃষ্টিতে নেচে ওঠার মতো ভাষা এইটা না। কলকাতার প্রভাব তো আছে, অস্বীকার করা যাবে না। কলকাতা এই ভাষার মূল ব্যবহারকারী ছিল, তাই। ভাষাকে মুসলমানি করানোর চিন্তা করে কোনো লাভ হবে না, অতীতেও হয় নাই, কমলার বদলে নারাঙ্গি চলে নাই, ভাষা তার পথে যাবে। আবার, কোলকাতার ভাষার সঙ্গে মিলবে না, ভাষা পৃথক হয়া যাচ্ছে, এই জুজুর, কিংবা অন্য কোনো জুজুর ভয় দেখায়া ভাষাকে অবরুদ্ধ করে রাখা যাবে বলেও আমার মনে হয় না, ভাষা মোগল হারেমে খোজাদের প্রহরাধীন নারী না। ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে টিকে থাকে, প্রয়োজন বদলায়। কারো কথা অনুযায়ী না, প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়।’
ভাষা বিষয়ে জহিরের এই সোজা-সাপ্টা বক্তব্য প্রমাণ করে তাঁর গল্প-উপন্যাসে ব্যবহূত ভাষারীতিকে খণ্ডিতভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই; ভাষার বিশেষ ব্যবহার তাঁর চেতনাসমগ্রেরই অচ্ছেদ্য অংশ।
ওই তো শহীদুল জহির
শহীদুল জহিরকে দেখতে চাই আমরা। না, তাত্ত্বিকদের ধূসর ব্যাখ্যায় তাঁকে দেখার আশা দূর-অস্ত। এই বসন্তে তাঁকে হয়তো দেখতে পাবেন ডলু নদীর হাওয়ায়, মাটি ও মানুষের রঙে, ঘেয়ো রোদের প্রার্থনায়। দেখতে পাবেন দক্ষিণ মৈশুন্দি কবরস্থান, গেণ্ডারিয়া নারী শিক্ষা মন্দির, ওয়ারির সিলভারডেল স্কুল, সাতকানিয়ার পথেপ্রান্তে অথবা নয়নতারা ফুল না থাকার ব্যাখ্যাহীন আগারগাঁও কলোনিতে। সেখানেও যদি না পান তাহলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেন থেকে নবগঠিত উত্তর ঢাকার র্যাডিসন ব্লু’তে জমে ওঠা সমসময়ের হরেক কিসিমের ইন্দুরবিলাইবান্দর খেলার নাছোড় ভাষ্যকার হিসেবেও দেখা যেতে পারে কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরকে।
ইচ্ছেপূরণের ফর্মাবদ্ধ ফ্যান্টাসিতে নয়, আকালু-টেপি-তৈমুর আলি-সমর্ত-তোরাপ-দুলালি-চান মিয়া-খৈমন-খারকোশ কিংবা নিমফল দাসীর অনিবার্য আখ্যানে আপনি খুঁজে পেলেও পেতে পারেন অতন্দ্র শহীদুল জহিরকে।
একজন অন্যবিধ রোদে পোড়া শহীদুল
নিজের কবিতায় শহীদুল জহির লিখেছেন—
কী একটা
আত্মগর্বের হীরকদ্যুতি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে
যখন সে বের হয়ে এল;
চোখে তার কোমল দীপশিখা;
তাকে কী নির্মম গরিব মন হলো আমার।
মনে হলো একটি সোনালি তেজি আলখাল্লা
খুলে ফেলে
রাত্রি এসে গেল, নরম হাতের ছোঁয়ার মতো।
রোদজ্বলা লোকটা একটু
সুস্থির হোক, একটু জড়িয়ে নিক অন্যবিধ
রোদে পোড়া জ্বলানি। এই বলে,
রোদের পেখম গুটিয়ে গোধূলির মতো রিক্ত
হয়ে গেল সে। ...
অতঃপর অজস্র ফাঁপা হুল্লোড়ের ভিড়ে অন্যবিধ নির্জন রোদে পোড়া শহীদুল জহিরের স্থায়ী ছায়া পড়তে থাকে আমাদের কথাসাহিত্যের ভুবনে।
তথ্যসূত্র :
* শহীদুল জহির সমগ্র (সম্পাদনা), মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা ২০১৩
* আমাদের ছোটরাস্তা, রবিশংকর বল, পরম্পরা, কলকাতা ২০১৩
* ব্যক্তিগত তথ্য-সহায়তা, রইস উদ্দিন (রঞ্জু)