বাংলামটর মোড়ে চারা বটগাছটার নিচে, যেখানে পুলিশের একটি বুথ আছে তার ঠিক লাগোয়া দেয়াল থেকে প্রথমে পোস্টার ছেঁড়া শুরু করে সে। দেয়ালে পোস্টার লাগাতে যেমন সাহস লাগে, তেমিন পোস্টার ছিঁড়তেও বুকে সাহস লাগে। লোকটি এসবের তোয়াক্কা করে না। সে কোথায় থাকে, কী করে এ বিষয়ে এখনো কোনো বিশদ ধারণা পাওয়া যায়নি। তার পোস্টার ছেঁড়ার গল্প অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই শহরে চাওড় হয়।
যে এগিয়ে থাকে তার সঙ্গে সহজে পারা যায় না। যেই খবর এল কে বা কারা বাংলামটর মোড়ে অমুক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। সেই অমুক দলের ছাত্র সংগঠনের কাঁধে দায়িত্ব পড়ল যে ব্যক্তি পোস্টার ছিঁড়েছে তাকে ধরে উচিত শিক্ষা দেওয়ার।
শহর নিয়ে যাদের সচেতনতা একটু বেশি, তাদের কারো কারো ধারণা ভোর থেকেইে সে পোস্টার ছিঁড়তে শুরু করে। নাইটগার্ডের পোশাক পরা একটি লোক এই কাজ করছে। গায়ে তার গ্রাম্য চকিদার স্টাইলের একটি মলিন শার্ট, দুই কাঁধ লুফ করা। শার্টের হাতা ব্যান্ড করা এবং লুফ দিয়ে বোতামের সঙ্গে লাগানো। পায়ের বুটজোড়া দেখে মনে হবে উনিশশ একাত্তর সনে অথবা তারও আগের কোনো কালের এক যোদ্ধা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় ফেলে রেখে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, কাদায় মেখে অবশেষ হয়ে আছে—রংজ্বলা, ক্ষয়িষ্ণু। পাটের চিকন দড়ি দিয়ে বুটের ফিতা বাঁধা। অনেকটাই গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখার মতো। বহুকালের পরিত্যক্ত, ইঁদুর ও তেলাপোকায় খাওয়া এবড়ো থেবড়ো করে ফেলে রাখা কোমরের কটিবন্ধনী। গভীর বেগুনি রংয়ের প্যান্টের ভেতর দিয়ে খাকি রংয়ের শার্টটি ইন করা। মাথার টুপিটি ব্যবহারের ফলে এর এমন একটা স্টাইল দাঁড়িয়েছে যে অন্য কারো টুপির স্টাইলের সঙ্গেই যার তুলনা মেলা ভার। খুব ভোরে কিংবা সম্ভাব্য সন্ধ্যায় তাকে পিজির বটগাছের নিচে কেউ কেউ শুয়ে থাকতে দেখেছে—এমন গুজবও রয়েছে। কিন্তু শুয়ে থাকা লোকটিই যে পোস্টার ছিঁড়ছে তার তো কোনো প্রমাণ নেই।
ইস্কাটনের একটি সরকারি বাংলোর সামনে সে দাঁড়ায়। বাংলোটির দেয়ালে লেখা—‘এখানে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। দেয়ালের লেখাটির পাশেই একটি পোস্টার গভীরভাবে সাঁটানো। তার হিসি পায়। কিন্তু হিসি না করে চেপে রেখে সে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। তার কাছে শহরটাই যেন একটা দেয়াল। চোখের সামনে দেয়াল ছাড়া কোনো দৃশ্য কি আদৌ আছে। আর দেয়াল মানেই তো রকমারি পোস্টার! একটি পোস্টারের গায়ে আরও তিন চার পাল্লা করে পোস্টার সাঁটানো। যেন পোস্টারগুলোকেও পোস্টার দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই সর্বত্র চাপ। চাপ খাওয়া জাতির দেয়ালের পোস্টারগুলোও চাপা পড়ে আছে চাপ খেয়ে। ইতিহাসের মতো। গুম, খুনের মতো।
একটা খুনকে চাপা দিতে আরেকটি নতুন খুন হয়। তখন পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিওর সাংবাদিকগণের ছোটাছুটি বাড়ে নতুন খুনের খবর সংগ্রহের জন্য। আর পুরাতন খুনটি চাপা পড়তে থাকে। কারণ, নতুন খুন ছাপা হয় প্রথম পাতায়। পুরাতন খুন চলে যায় ভেতরের পাতায়।
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় সে। তখন শহরের অভিজাত সমপ্রদায় সকালবেলার শারীরিক কসরত শেষে কেউ কেউ বাসায় ফিরছে। কেউ একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠায় দ্রুত পার্কের দিকে ছুটছে। শহরের ভিআইপি রোডে তখন রিকশাগুলো আপন ইচ্ছায় যাতায়াত করছে। কারণ, বাজার থেকে সবজি, তরি-তরকারি, ফলমূল রিকশায় চাপিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভিআইপি রোড দিয়ে সরাসরি যেতে পারছে। অবশ্য এই দৃশ্য নগরীর সুউচ্চ দালানগুলো ছাপিয়ে সূর্য ওঠা কিংবা ভোর আটটা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। সে এগিয়ে যায় মিন্টো রোডের দিকে। সেখানে একটি দেয়ালে একই পোস্টার অসংখ্য। ‘আগুন লাগাইয়া দিমু গায়’ নামের একটি সিনেমার পোস্টারে পুরো দেয়াল সাঁটা। এমনভাবে পোস্টারগুলো দেয়ালে সাঁটানো পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কেউ চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। সে এই পোস্টার ছিঁড়ল না। দেয়ালের সব পোস্টার যে সে-ই ছেঁড়ে তাও বলা সঠিক হবে না। কী কী পোস্টার সে ছেঁড়ে আর কী কী ছেঁড়ে না? এইভাবে কিছু না-ছেঁড়া পোস্টারের গল্পও ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরর সোশলজি ডিপার্টমেন্ট এই ছেঁড়া আর না-ছেঁড়া পোস্টার বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। তারা একটি রিসার্চ সেল গঠন করে। এক সপ্তাহ সময়সীমা কাল ধরে শহরের কয়েকটি জনপ্রিয় সরণিতে গবেষণা চালিয়ে দেখে কিছু পোস্টার ছেঁড়া হয়নি। তবে অনেক পোস্টার ঠিকই ছেঁড়া। তাদের এই জরিপকালীন সময়ের মধ্যেও শহরে বহু স্থানে পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে।
ছেঁড়া না-হওয়া পোস্টারগুলোর মধ্যে আছে—‘আজ বিশ্ব নিমদিবস, এ উপলক্ষে টিএসসির আলোচনা সভায় দলে দলে যোগ দিন—বিশ্বরাত্রি পরিষদ।’ ‘লড়াই! লড়াই! লড়াই! বিরাট ষাঁড়ের লড়াই, স্থান—ফুলপুর ময়দান।’ ‘লেডি টিউটর দিচ্ছি/নিচ্ছি।’ ‘গোলাপের ভবিষ্যত্ নিয়ে আলোচনা, বিষয়—আমরা রঙিন গোলাপ দিচ্ছি, স্থান—শাহবাগ।’ ‘আপনি কি যৌন সমস্যায় ভুগছেন? তাহলে আজ সন্ধ্যা ৬.০০ যৌনগন্ধী সেমিনারে যোগ দিন, স্থান—বাহাদুর পার্ক।’ ‘কাজের বুয়া সাপ্লাই’, ‘অর্শ গ্যেজ ভগন্দর চিকিত্সা’, ‘সর্বরোগের মহাঔষধ’, ‘আপনি কি স্বপ্নদোষে আক্রান্ত?’, ‘মিলনে আপনার শিশ্ন উত্থিত হয় না? আজই যোগাযোগ করুণ এই ঠিকানায়...।’ এইসব পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, পোস্টারের ধারণা কিভাবে পালটে গেছে। এখন সাইনবোর্ডও যেন পোস্টার!
অন্য এক ভোরে সে আবার বাংলামটর মোড়ে পূর্ব পার্শ্বের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে একটি নতুন পোস্টার। সে ছেঁড়ে না। একটু এগিয়ে যায়। রূপসীবাংলা হোটেলের মোড়, সেখানেও ওই একই পোস্টার—‘আপনি কি যৌন সমস্যায় ভুগছেন? রতিকালে আপনার কি স্বর্ণকমল ফোটে না? তাহলে আজই যোগাযোগ করুণ এই নম্বরে : ...’। সে পোস্টারটির সামনে দাঁড়ায়। ছিঁড়তে যেয়ে হাত বাড়ায়। পোস্টারটির কোনা ধরে। তারপরও ছেঁড়ে না। এই সমস্যায় ভুগছে দেশের কত লোক! কিন্তু এরা তো প্রতারক। তবে কি পোস্টারটি ছিঁড়ে ফেলবে, প্রতারণা তো বেশি অপরাধ। তবুও সে ছেঁড়ে না। মনে মনে কাকে যেন মাফ করে দেয়। ভাবে, মানুষ তবুও তো একটা সম্ভাবনা পাবে এখানে। আবার সে বিড় বিড় করে পোস্টারটি পড়ে—‘আপনি কি যৌন সমস্যায় ভুগছেন? রতিকালীন আপনার কি স্বর্ণকমল ফোটে না? তাহলে আজই যোগাযোগ করুণ আমাদের সেমিনারে ...।’ বেশ কাব্যিক। বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষের কথা মনে পড়ে তার। ফোন নম্বরটির উপর থুতু মারে এবং দ্রুত প্রস্থান করে।
একটু দূর থেকেই তার চোখে পড়ে আরেকটি পোস্টার লাল অক্ষরে লেখা ক্রাউন সাইজের সাদা কাগজে ছাপা—‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট! স্থান—ঘাসের মাঠ, শহরতলি।’ ধীরে সে দাঁড়ায়। ম্লান হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখমণ্ডলে। অনুচ্চ স্বরে ‘দেশটাই তো এমন, পুরো দেশটাই তো এমন’ বলতে বলতে সে সামনের দিকে এগোয়।
এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের গবেষকদল হন্যে হয়ে খোঁজে তাকে। কারণ, পোস্টার লাগাতে দেখা যতটা সহজ হয়, পোস্টার ছিঁড়তে দেখতে পারাটা তত সহজ নয়। যে পোস্টার ছেঁড়ে তার একটা ইন্টারভিউ তাদের প্রয়োজন হয়। নইলে এর রহস্য উদ্ঘাটনের কাজ অনেকটা অসম্পূর্ণ থাকবে। ইতোমধ্যে গবেষকদল পোস্টারের লেখার ধরন-তালিকা সম্পন্ন করে। পোস্টারের বাইরে শহরে বহু সংখ্যক বিলবোর্ড, নিয়ন সাইনসহ, পণ্যের বিজ্ঞাপন সম্বলিত সাইনবোর্ড ইত্যাদি যেসব দীর্ঘস্থায়ী পোস্টার রয়েছে, যেমন—‘সাদা সাদা আরও সাদা’, ‘জীবন ছল ছল মেঘের খাঁটি জল’ ইত্যাদি। তাতে গবেষকদলের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের বিষয় কাগজের পোস্টার।
সে এগোয়, তার চোখে পড়ে আরেকটি পোস্টার—‘অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!! টাকের মাথায় চুল গজানোর রহস্য!’ এই পোস্টারটি অপেক্ষকৃত উঁচুতে সাঁটানো। তার মনে পড়ে বন্ধু হরতনের কথা। বছর দু’য়েক আগে সে একবার গ্রামে গিয়েছিল। তার গাঁয়ের নাম বাদামতলা। সেখানে বাস করে তার ছোটবেলার দুই বন্ধু হরতন এবং কামার খাঁ। হরতনের মাথায় টাক। গ্রামে এমন টাককে বলে রাম টাক। কেন, কী কারণে এ ধরনের টাকমাথাকে রামটাক বলা হয় তা অবশ্য তার জানা নেই। কামার খাঁ উঠতে বসতে হরতনকে তার টাকের কারণে বেশ খোঁচা মেরে কথা বলে। হরতন মুখ বুজে সহ্য করে। যদিও তাদের তিনজনের বন্ধুত্ব গ্রামে দৃষ্টান্ততুল্য। একদিন তারা তিন বন্ধু গ্রামে একটি বিয়ের দাওয়াত খেয়ে ফিরছিল। হরতনের টাক মাথায় তেল দেওয়ায় দুপুরের রোদ পড়ে চিক চিক করছিল। পথের মধ্যে কামার খাঁ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে বসল—‘বন্ধু, তোর টাকটারে আজ যা লাগতেছে না! ঠিক যেন আমার বউয়ের পাছার মতো।’ যেন বহুযুগ মুখবুজে অপেক্ষার পর আজই একমাত্র হরতনের মুখ খোলার সেই অনিবর্চনীয় মুহূর্তটি ধরা দিলো। হরতন একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে হাতটি তার টেকো মাথায় আলতো করে বুলায়, বেশ আরমছে হাত বুলিয়ে কামার খাঁকে বলে, ‘তা যা বলেছিস বন্ধু।’ এরকম একটি উত্তরের জন্য কামার খাঁ কোনোদিনই প্রস্তুত ছিল না। মুহূর্তে সে হেসে ফেলায় কামার খাঁর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তো পড়লই, সঙ্গে অপমানের ভারটাও গেল বেড়ে। হরতন ও কামার খাঁ দুজনই একদম চুপ হয়ে রইল। সেই থেকে কামার খাঁ হরতনের টাক নিয়ে আর কোনো কথা বলে না। তার মাথায় ভাবনা এল, এই পোস্টারটি যদি হরতন দেখত তবে নিশ্চয়ই ওর মনে একটু হলেও আশার সঞ্চার হতো। বন্ধুর সৌজন্যে এই হাস্যকর পোস্টারটি সে ছিঁড়ল না।
মহানগর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নগর সৌন্দর্য বিধান বিভাগ কিন্তু এই পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনায় ভেতরে ভেতরে বেশ খুশি। কারণ, উচ্ছেদ অভিযান ছাড়াই নগরে পোস্টার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আর পোস্টার উচ্ছেদ অভিযান বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। চাইলেই বুলডোজার দিয়ে দেয়ালের পোস্টারগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটা একটা করে পোস্টার ছিঁড়তে হয়, কোনো পোস্টার ছিঁড়তে চাকু লাগে, পানি লাগে। অভিযান চালনার খরচে কোনো টান পড়ছে না। খরচের ভাউচার হচ্ছে, কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান লাগছে না।
লক্ষণীয় বিষয়, পাড়া কিংবা সংকীর্ণ গলির ভেতরের পোস্টারগুলোর প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। শহরের প্রধান প্রধান সরণির দেয়াল জুড়ে সাঁটানো পোস্টারগুলোই সে ছেঁড়ে। পোস্টার বিষয়ে তার অভিজ্ঞতাও অপরিসীম। সে লক্ষ করে দেখে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ পোস্টারই ভার্টিক্যাল। ভার্টিক্যাল পোস্টারের জন্য অপেক্ষাকৃত কম জায়গা প্রয়োজন। আর হরাইজেন্টাল পোস্টারের জন্য বেশি স্পেস দরকার। এত স্পেসই বা কোথায় এই সংকীর্ণ নগরে। পোস্টার লাগানোর স্টাইল দেখে সে বুঝতে পারে এর গায়ে লাগানো আঠার ধরন-ধারন। কোনটা গাম, কোনটা আইকা, কোনটা ময়দা অথবা কাফল্যা গাছের কস থেকে উত্পন্ন আঠা। এমন কি পোস্টারের সাইজ এবং ধরন দেখেও সে অনায়াসে বুঝে নেয় কোন পোস্টার কোন অঞ্চল থেকে এসেছে—মিরপুর না পুরান ঢাকার, উত্তরা না শ্যামলীর, যাত্রাবাড়ী না গুলশানের, বারিধারা না পুরানা পল্টনের কিংবা মতিঝিল না শাহবাগের।
পরদিন ভোরে কুয়াশানিবিড় ঢাকার রাজপথে শাহবাগের রাস্তা ধরে সে এগোয়। এ শহরে এখন কুয়াশার জন্য আর শীতকালের দরকার হয় না। ধুলোর সঙ্গে একটু ডার্কলাইট মিলে কুয়াশার যে আস্তরণ তৈরি হয় তা এ শহর জুড়ে সারা বছরই থাকে। শীতের মতোই সকাল আর সন্ধ্যা এ শহর যেন কুয়াশাময়। সে এগোয় জাতীয় জাদুগরের দেয়াল ঘেঁষে। জাদুঘর থেকে পাবলিক লাইব্রেরির দিকে একটু এগোলেই এই শহর এবং শহরকে নিয়ে যারা তিলোত্তমাবিলাসী স্বপ্ন দেখে তাদেরকে কুর্ণিশ না-করে একটি তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে বহুকিছুর সাক্ষী হয়ে। মানুষের আই-লেভেল ছাপিয়ে সে অনেক আগেই উঠে গেছে তার লেভেলে। ফলে ছোটবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের ‘তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’ থাকা কবিতাটির এই যৌবনবেলায় সে ঢাকায় এসে মর্মার্থ খুঁজে পায়। এই তালগাছটিকে সহজে কারোর চোখে পড়ে না। এমন কি বিকেলে যারা এই তালগাছটির গায়ে হেলান দিয়ে ফুচকা খায়, গুলতানি মারে তাদের অনেকেই জানে না যে এটি তাল গাছ। অত ওপরে চোখই বা যায় এ শহরের ক’জনের। আই লেভেলের জোড়ে যেটুকু বা চোখে পড়ে তাতে লেখা আছে, ‘পড়াতে চাই’, টিউশনি দিচ্ছি’, ‘সুন্দর হাতের লেখার জন্য’, ‘পাথরে কি ভাগ্য ফেরে?’, ‘সব সমস্যার সমাধান পাথরে আছান’, ‘বনলতা লেডিস টেইলার্স’ এবং ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ ইত্যাদি। তবে এইসব ছোট ছোট পোস্টারের ভিড়ে চাপা খাওয়া একটি পোস্টার উঁকি মারছে, তাতে লেখা—‘শ্বাস দেব তো গ্যাস দেব না’। অবশ্য সব ছাপিয়ে একটু ওপরে লেখা আছে—‘আপনি কি যৌন সমস্যায় ভুগছেন?’ তবে এটিকে পোস্টার বলা যায় না। টিনের পোস্টার। পেরেক দিয়ে ঠোকা। এ থেকে আরেকটু ওপরে তাকালে দেখা যাবে, এইসব ক’টি পোস্টারকে ছাপিয়ে কপালে লালফিতা বাঁধা যুবকের মতো এক খণ্ড লাল নিশান কে যেন বেঁধে রেখে গেছে অনতি ওপরে কোন ভোরে, কে জানে!
সে এগোতে থাকে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে চারুকলার পাশ ঘেঁষে। হাঁটতে হাঁটতে নগরে সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যার আবছা আলোয় মুখগুলো কেমন অস্পষ্ট হতে থাকে। এবার তার চেপে রাখা পেচ্ছাবের বেগ যায় বেড়ে, মনে হয় কোনোমতে আর সামলানো যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলের দেয়াল ঘেঁষে কাঁঠালচাপা গাছটার নিচে সে দাঁড়ায়। চেপে রাখা পেচ্ছাব খোলা জিপারের ফাঁক দিয়ে বেশ তোড়ে দেয়ালের ওপাশে গিয়ে পড়ে। তখন অন্ধকার আর নিয়ন আলোর যৌথ সমঝোতায় সব মুখ অচেনা মনে হয়। অবশ্য এই শহরের রাজপথে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে হলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব চেনা মুখগুলোকে অচেনা মনে করতেই হবে। দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখা পেচ্ছাব দেয়ালের ওপাশটায় যেখানে গিয়ে পড়ে সেখানে পরপর করে শব্দ হয়, তার বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তার এই পেচ্ছাব একটি ছেঁড়া পোস্টাররের ওপরই পড়ছে। আঁধার, নিয়ন আলো এবং পেচ্ছাবের তোড়ে পোস্টারের লেখা অক্ষরগুলোকে আর চেনা যায় না।
এবার নিজেকে অনেকটা নির্ভার লাগে তার। সে আবার এগোয়। কিন্তু একটু সামনে এগোলেই পেয়ে যায় আরেকটি পোস্টার। রাজু ভাস্কর্যর সামনে। দ্রুত পোস্টারটির সামনে দাঁড়ায়, অফসেট কাগজে লাল কালিতে হাতে লেখা পোস্টার—‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্বৈরাচার নিপাত যাক’। পলকেই ছিঁড়ে ফেলে সে। ছিঁড়ে ফেলা পোস্টারটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে গিয়ে রিকশাযাত্রীর গায়ে পড়ে। মুহূর্তেই সে ফিরে দেখে তাকে ঘিরে ধরছে একদল যুবক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিলঘুষি, লাথি, থাপ্পড় খেয়ে সে নিচে পড়ে যায়। কিন্তু নিয়ন আলো আর আঁধারের কারসাজিতে কেউ কাউকে চিনতে পারে না। সে উঠে এক দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অবশেষ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়।
নগরে পোস্টার ছেঁড়ার এই কাহিনি জাতীয় দৈনিকের পৃষ্ঠায় যথেষ্ট গুরুত্বসহ ছাপা হতে শুরু করে। পুরোনো আর্কাইভ থেকে পোস্টারের ছবি দিয়ে গ্রাফিক্স করে দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদসহ বেশ কয়েকটি দৈনিক এই খবর প্রথম পাতায় ছাপে। ‘টক অব দ্য টাউন’ শিরোনামে কোনো কোনো ইংরেজি দৈনিকের ফ্রন্ট পেজে ডিসি কলামে সচিত্র রিপোর্ট ছাপা হয়। কোনো সাংবাদিকই পোস্টার ছেঁড়নকারীর কোনো যথাযথ তথ্য দিতে পারে না। সকালে সবাই খবর পড়ে সংবাদপত্রের প্রতি আরেকবার বিরক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পায়। সন্ধ্যার পর পর প্রায় সব ক’টি টিভি চ্যানেল এই ঘটনা নিয়ে টক শো প্রচার করে। কিছু বাকপটুজীবী, চিন্তক এবং এলিট সোসাইটির প্রতিনিধির কেউ কেউ এই টিভি টক শোতে অংশ নেয়। প্রায় দেখে ফেলেছিল এমন দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে হাজির করে কোনো এক টিভি চ্যানেল প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে থাকে! আর প্রায় প্রত্যক্ষদর্শীরা তার রোমাঞ্চকর কাহিনির বর্ণনা করে। কিন্তু দর্শক চায় ঘটনার মূল জানতে। তারা রহস্য-টহস্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। শেষপর্যন্ত জনগণ যখন শেষপর্যন্ত দেখে বুঝতে পারে যে, এটা রহস্যজনক এবং ঘটনাটিকে আরও অনেক ঘটনার মতো রহস্যময় করে তোলা হবে কিংবা রহস্যই থেকে যাবে, তখন টিভি ও পত্রিকার পাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্রোধ আটকে না রাখতে পারা দু-একজন গোপনে গালি দেয়—‘বাইনচোত্, জানে না বালটাও বলতে চায় সালটাও।’
এইভাবে পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনা মিডিয়াতে তোলপাড় হয়। যেহেতু কেউ রসহ্যের কিনারা জানে না তাই জনগণের শেষপর্যন্ত ধারণা হয় যে, এই খবর আসলে ভুয়া, গুজব। জনগণের মন, চক্ষু অন্যদিকে ঘুরাইতেই এই ঘটনার জন্ম দেওয়া হয়েছে। দেশে এত বড় ঘটনা ঘটল, গুম হইল ডজনকে ডজন খুন হইল হাজারে। আগে শুনতাম খুন। এখন জোড়া খুন। হালি খুন। ডজন খুনের নিচে খবরই হয় না। এইসব গুমখুনের বড়বড় ঘটনাকে চাপা দিতেই মিডিয়া এই গল্প বানাইছে। ঘটনার একপর্যায়ে লোকজন এমনটাই ভাবতে শুরু করে। তারা এও ভাবতে শুরু করে যে, দেশে আরও বড় ঘটনা ঘটছে যা টের পাবার আগেই এই গুজবের পোস্টারে সয়লাব সারা শহর।
তারা ভাবে, পোস্টার আসলে কেউ ছেঁড়ে না, ছেঁড়ায়। তাছাড়া পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে কিনা তা-ই বা কে দেখেছে! সবাই পোস্টার ছেঁড়ার গল্পে মত্ত। কিন্তু দেয়ালে পোস্টার আছে না সব ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে তার তো কোনো খোঁজ কেউ দিচ্ছে না! এইভাবে রাত বাড়ে, রাতের কোনো না কোনো সময়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কাল সকাল হবে। সকালে জাগতে হবে।
সকালে যারা কাজে ছুটছে তাদের প্রত্যেকেরই চোখ আশপাশ খোঁজে। প্রতিটি উত্সুক চোখ চায় প্রতিটি চোখের ভেতর। যদিও তারা প্রত্যেকেই একটি দেয়াল খোঁজে। কিন্তু দেয়াল খোঁজার চোখগুলো পরস্পর পরস্পরের চোখে ভেতরে চায়, কে জানে তারা কি কিছু দেখতে পায়! প্রত্যেকের চোখই প্রত্যেকের দিকে আর প্রত্যেকেই ভাবে তার চোখ দেয়ালের দিকে! কিন্তু সেই চোখ যে দেয়ালের দিকে চায় এবং দেয়ালে ছেঁড়া পোস্টার দেখার আশায়, সাথে যদি পোস্টার ছেঁড়া লোকটিকেও দেখা যায়... এইভাবে নগরে একটি দিন শুরু হয় এবং একসময় সন্ধ্যা নামে।
প্রথম পাতার খবরটি ক্রমশ জাম্প করে তৃতীয় পাতায় যাওয়া শুরু করে। থ্রি-সি কলাম থেকে ডিসি কলাম এরপর সিঙ্গেল কলাম। তৃতীয় পাতা থেকে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ, ষষ্ঠদশ, সপ্তদশ তারপর যেকোনো পাতা। প্রথম পাতায় কোনো মতে হেডলাইন ছাপা হয় এবং আমরা জাম্প পড়ার জন্য ভেতরের কোনো একটি পাতার ওপর ভরসা করতে থাকি। অন্তত ছাপা হয়েছে এতেও আশ্বস্ত থাকা কম কথা নয়। একদিন ভোরে সংশয় জাগে, আদৌ নিউজটি ছাপা হয়েছে তো!
এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও পোস্টার ছেঁড়া লোকটাকে কেউ শনাক্ত করতে পারে না। তাকে ধরার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এই নিয়ে চারকালারের রঙিন পোস্টার ছাপা হয় এবং ঢাকার প্রায় সব দেয়ালেই এই পোস্টারটি শোভা পায় যাতে লেখা আছে—‘নগরের পোস্টার ছেঁড়া গণদুশমনকে ধরিয়ে দিন এবং ৫০,০০০ টাকার পুরস্কার নিন।’ ইতোমধ্যে ঢাকার কয়েকটি অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকজন নিরীহ লোককে ধরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউই পুরস্কার নিতে পারে না, কারণ ধৃত ব্যক্তিরাই যে পোস্টার ছেঁড়ে তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তারা দিতে পারে না।
নিজেকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা সম্বলিত এই রঙিন পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, নিজেকে কি নিজেই ধরিয়ে দেওয়া যায়।