
ইতিহাসের একটি বিচিত্র চিত্র খুব লক্ষ্য করার মতো। রাষ্ট্র বা জাতির নির্মাণে যাঁরা মূল ভূমিকা পালন করে অবিস্মরণীয় নায়ক হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্য দিতে হয়েছে। ধরা যাক উপমহাদেশের মহাত্মা গান্ধীর কথা। তিনি ভারতের জাতির জনক, কিন্তু স্বাধীনতার পর স্বাধীন ভারতে মাত্র এক বছরের মতো বাঁচতে পেরেছিলেন। উগ্রবাদী ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার প্রধান রূপকার আহমেদ সুকর্ণের অন্তিম সময়ের সুদীর্ঘ অংশ কেটেছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় কারাগারে। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার মূল নায়ক বন্দরনায়েক ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন। ফরাসি শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে আলজিরিয়ার যে মহান পুরুষ সেখানকার জনগণকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিলেন, সেই আহমেদ বেন বেল্লাকেও কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে শেষ দিনগুলো কাটাতে হয়েছে। ইতিহাসের বাঁক নির্মাণে ভূমিকা রাখার পরিণতিতে ঘাতকের হাতে প্রাণ গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির প্রতীক মার্টিন লুথার কিং-এর। কৃষ্ণ আফ্রিকার প্রথম সূর্যোদয়ের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মোশে শোম্বে—কাসাভুবু চক্র। কিউবা বিপ্লবের অন্যতম রূপকার চে গুয়েভারাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল বলিভিয়ার জঙ্গলে। চিলির আলেন্দেও এভাবে নিঃশেষে প্রাণদানের আর এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এধরনের হত্যাযজ্ঞের সবচাইতে নির্মম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। বাঙালি জাতিসত্তার প্রথম সফল রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে এই বিচিত্র চিত্রটি ইতিহাসের কাছে ধরা দেয়। কেন এধরনের ঘটনা ঘটে এটা যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এঁরা প্রত্যেকেই প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে নিজের প্রাণের বিনিময়ে সত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এটা বুঝতে কষ্ট হবে না যে এঁরা প্রত্যেকেই শৃঙ্খলিত মানবতার মুক্তির প্রয়োজনে নিজ নিজ ভূমিতে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করেছেন যা কায়েমী স্বার্থবাদী মহলকে ক্রুদ্ধ এবং ক্ষুব্ধ করেছে। ফলে তারা সময় এবং সুযোগ বুঝে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে।
মানব জাতির এ লড়াই শুধু আজকের নয়, সব সময়ের, সব কালের। ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে এর সূচনা। স্পার্টাকাস ক্রুশবিদ্ধ হয়ে কালের পাতায় মহাবিদ্রোহের যে সাক্ষ্য রেখেছিলেন, মঙ্গল পাণ্ডে এবং সূর্যসেনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তা এসে পৌঁছেছে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে। আর সেখানেই যাঁর হাতে ধরে ঘটল একটি বিশাল জাতিগোষ্ঠীর অভ্যুদয়, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ফরিদপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
আজ ভাবতে অবাক লাগে এই অসাধারণ মানুষটি কীভাবে তিল তিল করে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। শেখ মুজিব—টুঙ্গিপাড়ার সেই কৃশকায় তরুণটি কিন্তু কখনও কোনও বিশাল প্রাপ্তির জন্য তাঁর পথপরিক্রমা নির্ণয় করেননি। প্রথম যে বিশ্বাস তাঁর আত্মাকে বশীভূত করেছিল, তা হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাই তাঁকে ধীরে ধীরে নিয়ে গেছে অমরাবতীর দিকে। এই মানবতাই তাঁকে চিনিয়েছে ন্যায়, সত্য এবং অধিকারের জন্য বিরামহীন সংগ্রামের মহাসড়কটিকে। আর সেই পথে তিনি হেঁটেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। অতৃপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো মহাকালের গর্ভ থেকে টেনে এনেছেন ধূলি-ধূসরিত একটি বিস্মৃতপ্রায় জাতিসত্তার অস্তিত্ব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিপরীত সে াতের বিরুদ্ধে লড়াই করেই মহামানব ইতিহাসের সন্তানে পরিণত হন। তাঁর ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। প্রতিকূল পরিস্থিতি, যুদ্ধ, ক্ষুদ্রতা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, জাত্যাভিমান— সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই মানুষটি দিনের পর দিন লড়াই করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থ তাঁকে স্পর্শ করেনি। হিংসা কিংবা লোভ তাঁকে পরাস্ত করেনি কখনও। যেদিন থেকে তিনি রাজনৈতিক চেতনাকে ধারণ করলেন অন্তরে, সেদিন থেকেই ভেবেছিলেন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের সূত্রটি খুঁজে বের করতেই হবে। এই জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আর এর জন্য প্রয়োজন একটি ভৌগোলিক ভূখণ্ডের। বাঙালির জন্য, বাঙালির পৃথক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য তাঁর মতো এতো গভীরভাবে অনুভব আর কেউ করেনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাদের শক্তি, তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণেই আমাদের মুক্তি, তাঁর স্বপ্নই আমাদের প্রেরণা। প্রতিটি পনেরোই আগস্ট আমাদের কাছে আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক।