এবারের আসন্ন বইমেলা নিয়ে আশা ও আতংকের দোলাচলে দুলছেন প্রকাশকরা। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে মেলাকে বাংলা একাডেমির বাইরে রাস্তায় নিয়ে আসার ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি—সব মিলিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে প্রকাশকদের মধ্যে। ফলে মেলা উপলক্ষে নতুন বই প্রকাশ ইতস্তত করছেন অনেকেই। সে কারণে প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'কে সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বছর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে বইমেলা জমে ওঠেনি। বিক্রিতেও ছিল মন্দা। এবারও কয়েক মাসব্যাপী একটানা রাজনৈতিক সহিংসতার ফলে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন প্রকাশকরা। তাদের উত্কণ্ঠা—ফেব্রুয়ারি মাসেও একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে না তো? সে কারণে বইমেলা শুরু হতে আর মাত্র ১২ দিন বাকি থাকলেও পুরানো ঢাকার বাংলাবাজারে মেলাকে ঘিরে প্রতি বছরের সেই ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। প্রকাশকরা নতুন বই ছাপাতে দ্বিধান্বিত থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন প্রেস মালিক-শ্রমিকরা। বইপাড়া বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিবছর বইমেলা শুরুর আগে যে রমরমা অবস্থা দেখা যেত সেই পরিস্থিতি এবার নেই। কেমন যেন নির্জীব, অলস সময় কাটছে প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
এদিকে বইমেলার পরিসর ও স্থান নির্ধারণ নিয়েও উদ্বেগে আছেন প্রকাশকরা। তারা বলছেন, পুরো মেলাকে যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হতো তবে মেলার নিরাপত্তা জোরদার করা সম্ভব হতো। কিন্তু রাস্তায় যখন বইয়ের স্টল নির্মাণ করা হবে তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকটি পুরোপুরি আড়ালে চলে যায়। ফলে ঝুঁকিতে থাকবে স্টলগুলো। গতবছর বইমেলায় আগুন ধরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সে কারণে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ নিজস্ব চত্বরে ঘিঞ্জি স্টল নির্মাণ করে বাংলা একাডেমির ভবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছে না।
পাশাপাশি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নির্মাণাধীন বিক্রয়কেন্দ্র ভবনের কারণে আগের চাইতে বইমেলার স্থানও কমে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে বইমেলাকে এবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলা একাডেমি সংলগ্ন রাস্তায়। মূল প্রকাশকদের স্থান দেয়া হচ্ছে রাস্তায়। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো রাস্তাজুড়ে বসবেন মূল প্রকাশকরা। মেলার মূল মঞ্চ, অপেক্ষাকৃত নবীন প্রকাশক, লিটল ম্যাগাজিন, সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকবে ভেতরের চত্বরে। তবে এতেও মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, গত বছর বইমেলায় আগুন ধরে একাডেমির মূল ভবনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। তাই আমরা ঝুঁকি নিতে পারি না। আমরা চেয়েছি বইমেলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণের বাইরে যাক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হলে ভাল হতো। কিন্তু প্রকাশকদের সম্মিলিত প্রত্যাশার কারণে মেলা রাস্তায় নেয়া হয়েছে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও বলা হয়েছে যে, প্রকাশকদের স্টলগুলো সব এক জায়গায় রাখতে। সেটা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়তো শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। কিন্তু একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু প্রকাশকদের চাহিদার কারণে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি ধ্বংসাত্মক রাজনীতি যেন বইমেলাকে স্পর্শ না করে এ বিষয়ে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, অবরোধে মানুষ ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই বইমেলায় আসার বিষয়ে সবারই আগ্রহ রয়েছে। তাই বইমেলাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা সব দলেরই দায়িত্ব। এই সহিংস রাজনীতির কারণে কোন প্রকাশকই বই ছাপানোর বিষয়ে খুব একটা উদ্যোগ নেয়নি। এখন মেলার আগে এসে কিছু কিছু বই প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। কারণ অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে ঘিরেই সব প্রকাশক তাদের লগ্নি করে থাকেন। আমাদের প্রকাশনা জগতে এই বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারও প্রকাশকদের বইমেলায় বই প্রকাশের জন্য ১০ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সবদিক বিচার করে বইমেলা যেন ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কবলে না পড়ে সে ব্যাপারে সকল দলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নতুন প্রজন্মের প্রকাশক তাম্রলিপির এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি বলেন, বইমেলা এবার জমবে। মানুষ ঘরে আটকে থেকে বিরক্ত। ফলে তারা বইমেলায় আসতে চাইবে। সে কারণে এবার বেশি বেশি নতুন বই প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি বইমেলাকে ঘিরে সহিংস রাজনীতির পথে হাঁটেন তবে তারা জনসমর্থন হারাবেন। তাই সবার সহযোগিতায় বইমেলাকে সফল করাই হবে সব দল ও মানুষের জন্য মঙ্গল। সহিংস রাজনীতির কবলে না পড়লে এবারের মেলা সফল হবেই। তিনি বলেন, মেলা বাংলা একাডেমির রাস্তায় না করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করলেই ভাল হতো।
শোভা প্রকাশের প্রকাশক মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বইমেলার প্রকাশনার কাজ এখনো শুরুই করিনি। গত বইমেলা খুব খারাপ গেছে। সে ধকল আমরা সারাবছরেও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এবারের মেলায় সব প্রকাশকদের মাঝে বোমা আতঙ্ক কাজ করবে। মেলা নিয়ে রাজনীতি না করে পাঠকদের নিরাপত্তার স্বার্থে বইমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও মেলা নিয়ে রাজনীতি না করার আহ্বান জানান তিনি।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে উত্সর্গ করা হবে মেলা
যেসব প্রকাশক দুই থেকে তিন ইউনিটের স্টল পাবে তাদের স্থান হচ্ছে একাডেমির দেয়াল সংলগ্ন মূল সড়কে। অপেক্ষাকৃত নবীন প্রকাশক যারা এক ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পাবে তাদের স্থান হবে একাডেমির ভেতরে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে যাদের প্রকাশনা রয়েছে তাদেরও স্টল থাকবে একাডেমির প্রাঙ্গণে। সেই সঙ্গে থাকবে প্রবাসী লেখকদের জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি স্টল। আগের জায়গাতে অর্থাত্ বহেরা তলায় থাকছে লিটলম্যাগ কর্নার। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য নজরুল মঞ্চটিও এবার ব্যবহার করা হবে। একাডেমির প্রাঙ্গণে যথারীতি থাকছে মিডিয়া কর্নার। এবারের মেলাটি উত্সর্গ করা হবে সদ্য প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের স্মৃতি উদ্দেশে।
গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের জন্য ৩২০টি প্রকাশনা সংস্থা আবেদন জমা দিয়েছে। স্টল বরাদ্দের লটারি আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। ২৫ জানুয়ারি বাছাইকৃত প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে স্টল বুঝিয়ে দেবে একাডেমি। ৩১ জানুয়ারি সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে মেলার সাংবাদিক সম্মেলন।
একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানায়, এবারের মেলায় প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে চার ইউনিটের স্টল থাকছে। চার ইউনিটের স্টল কারা পাবে সে বিষয়ে প্রকাশকদের দুই সংগঠন সিদ্ধান্ত নেবে।