দক্ষিণ মেরু হলো অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণ বিন্দু। যা উত্তর মেরুর ঠিক বিপরীতে অবস্থিত এবং যা প্রকৃত দক্ষিণকে নির্দেশ করে। বরফ শীতল এই অ্যান্টার্কটিক সাম্রাজ্যে বসবাস করা কষ্টকরই নয়, বলা যায় একরকম দুঃসাধ্য কাজ। আর এই কাজটিই খুব সুন্দরভাবে করে একদল পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইন ও অ্যান্টার্কটিকার কথা জানাচ্ছেন প্রাঞ্জল সেলিম
ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ মেরু হলো দক্ষিণ গোলার্ধের সেই বিন্দু যেখানে ভূ-পৃষ্ঠকে পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর কাল্পনিক সরলরেখা (পৃথিবীর অক্ষ) ছেদ করেছে। তবে লক্ষণীয় যে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু বা ভোগলিক দক্ষিণ মেরু আর ভূ-চুম্বকীয় মেরু দুইটি পৃথক জিনিস।
ভূ-প্রকৃতি ও অবস্থান :দক্ষিণ মেরু হলো অ্যান্টার্কটিকার বৈশিষ্টহীন, ঝড়ো বাতাসময়, বরফে আচ্ছাদিত এক জায়গা, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৮৩৫ মিটার (৯,৩০৬ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত এবং নিকটবর্তী সমুদ্র ম্যাকমুর্ডো সাউন্ড থেকে প্রায় ৮০০ মাইল (১,৩০০ কিমি) দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ মেরুতে বরফের আচ্ছাদন প্রায় ২,৭০০ মিটার (৯,০০০ ফুট) পুরু অর্থাত্ দক্ষিণ মেরুর প্রকৃত ভূ-পৃষ্ঠ প্রায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার সমান। উত্তর মেরুর মতো কঠিন না হলেও দক্ষিণ মেরুকে সূক্ষ্মভাবে শনাক্ত করা মুশকিল। সময়ের সাথে সাথে দক্ষিণমেরুর অবস্থানও সামান্য পরিবর্তন হয়। এর কারণ হলো নিজ অক্ষের উপর পৃথিবীর ঘূর্ণন সুষম নয়। তাছাড়া দক্ষিণ মেরুর বরফের আস্তরণ প্রতি বছর গড়ে ১০ মিটার করে ৩৭-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের দিকে সরে যাচ্ছে।
আবিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :প্রথম মানব হিসেবে দক্ষিণ মেরু জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড এমুন্ডসেন। তিনি তার দল নিয়ে ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ মেরুতে সর্বপ্রথম পা রাখেন। রোয়াল্ড এমুন্ডসেনের পৌঁছার প্রায় একমাস পর তার প্রতিযোগী রবার্ট ফ্যালকন স্কট দলবল নিয়ে দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান। তবে ফেরার পথে রবার্ট ফ্যালকন স্কট ও তার সহযাত্রীরা প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে মারা যান। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী আর্নেস্ট স্যাকেলটন জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ মেরু পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন কিন্তু তার জাহাজ বরফে আটকা পড়ে যায় এবং এর ১১ মাস পর তিনি মারা যান। রোয়াল্ড এমুন্ডসেন এবং রবার্ট ফ্যালকন স্কটের পর দীর্ঘদিন কেউ দক্ষিণ মেরুতে যাত্রা করেননি। এরপর ১৯৫৮ সালের ৪ জানুয়ারি দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান এডমুন্ড হিলারি (ইনিই সেই হিলারি যিনি প্রথম এভারেস্ট জয় করেন) এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুতে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য অভিযাত্রীর পদধূলি পড়েছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু :দক্ষিণ মেরুতে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘড়ির সময় নেই এবং পৃথিবীর ন্যায় কোনো টাইম জোন নেই। উত্তর মেরুর চেয়ে দক্ষিণ মেরুতে ঠাণ্ডা অনেক বেশি। কারণ দক্ষিণ মেরু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে (৯,৩০৬ ফুট) আর উত্তর মেরু প্রায় সমুদ্র পৃষ্ঠের সমতলে অবস্থিত। শীতকালে দক্ষিণ মেরুতে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৬৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। দক্ষিণ মেরুতে এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা মাইনাস ১৩.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৮২.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। দক্ষিণ মেরুর জলবায়ু মরুময়। ঝড়ো হাওয়া আর তুষার-ঝড় এখানকার আবহাওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাতাসের আর্দ্রতা প্রায় শূন্য। বৃষ্টিপাত হয় ২-৩ বছরে একবার। প্রবল বৈরী আবহাওয়ার কারণে দক্ষিণ মেরুতে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ জন্মায় না। তবে স্কুয়া নামক এক ধরনের পাখি সেখানে বছরে দু-একবার উড়তে দেখা যায়। এছাড়া সেখানে কিছু অনুজীব বসবাস করে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। তবে দক্ষিণ মেরু ছাড়া অ্যান্টার্কটিকার বাকি অঞ্চলজুড়ে 'কোট পড়া ভদ্রলোক' পেঙ্গুইনের বসবাস। বরফাচ্ছাদিত মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকার বাসিন্দা বড় পেঙ্গুইনরা নিজেদের উষ্ণ রাখতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেয়। দক্ষিণ মেরুর বরফশীতল ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরা একে অন্যের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে এবং থেমে থেমে ধীরে ধীরে চলাফেরা করে। দৃশ্যটা অনেকটা তীব্র যানজটে আটকে থাকা এলোমেলো গাড়ির সারির মতো। জার্মানির একদল গবেষক এ তথ্য জানিয়েছেন। নিউ জার্নাল অব ফিজিকস সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়, সম্মিলিত পথচলার সময় প্রতিটি পেঙ্গুইন পাশের সঙ্গীর ডাকে সাড়া দিতে বা কোনো দিকে এগোতে মাত্র দুই সেন্টিমিটার নড়াচড়া করে। হাজার হাজার পেঙ্গুইনের এমন পদক্ষেপকে সাগরে বহমান ঢেউ বলে ভুল হতে পরে। আর এই কৌশল অবলম্বন করে ছোট আকারের পেঙ্গুইনরা তুলনামূলক বড় পেঙ্গুইনদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগও পায়। দক্ষিণ মেরুতে পেঙ্গুইনের সংখ্যা হবে প্রায় ৬০০০০০। তবে আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, এই সংখ্যা তার দ্বিগুণ। এই গবেষণাটি করেছে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে। মেরু অঞ্চলে বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্রের ভাসমান বরফের উপরে উপনিবেশ করে থাকে এই পেঙ্গুইনরা।