'ধর্মের দোহাই দিয়ে কিংবা জিকির তুলে নারীকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না। ইসলাম নারীর অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নারী পুরুষ সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে। যারা নারী-বিদ্বেষী অপপ্রচার করেন, তারা কেন ভুলে যান রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী নারী হজরত বিবি খাদিজা নিজে তার ব্যবসা পরিচালনা করতেন। হজরত বিবি আয়েশা (রা.) নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নারীর ন্যায্য অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সমতা-ভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।' আজ শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৪ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সব কথা বলেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হলো 'অগ্রগতির মূল কথা, নারী-পুরুষ সমতা'।
যারা দুই নেত্রীর সমালোচনা করেন তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'অন্য দেশের অন্য রাজনৈতিক দলের যারা প্রধান, তাদের ক্ষেত্রে তো বলা হয় না, দুই পুরুষের যুদ্ধ বা দুই পুরুষের ঝগড়া। বাংলাদেশে দুই নারী, দুই নারী বলা হচ্ছে। আমরা কেন পারলাম, সেটাই তাদের মাথাব্যথা। আগে তো শুনতাম—মেয়েরা বেশি হিংসা করে। এখন তো দেখি পুরুষরাই বেশি হিংসুটে।'
বিগত ওয়ান-ইলেভেনের পেক্ষাপটের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পুরুষ প্রচেষ্টাই ছিল মাইনাস টু। এখন মাইনাস থ্রি। টু প্লাস ওয়ান (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এশরাদ এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া)।'
অধিকার আদায়ে নারীদের সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'অধিকার দাও, অধিকার দাও বললে হবে না। কেউ অধিকার ছাড়তে চায় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।' এ সময় নারী হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং এখনো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান রওশন এরশাদকে নিজের সহযাত্রী হিসেবে আখ্যা দেন।
নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার জন্য ধর্মের অপব্যাখ্যা ও নারী-বিদ্বেষী অপপ্রচার বন্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের নারীরা যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে, তখন দেখা গেছে—একটি মহল ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারী-বিদ্বেষী অপপ্রচার করে নারীদের গৃহবন্দী করে রাখতে চায়। শিক্ষা ও জীবিকার অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করতে চায়।'
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কোন জায়গায় নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার নির্দেশ দেয়া আছে—জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পবিত্র ইসলাম ধর্মই নারীর সম্মান নিশ্চিত করেছে, শিক্ষা ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। কাজেই আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সমতা-ভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার করি। এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে নারীর ন্যায্য অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। নারীকে উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব। নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের কাছে একটি মডেল হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'নারীরা এখন বিশ্বব্যাপী ত্রিমাত্রিক দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত, পারিবারিক ও ঘর-গৃহস্থালি পরিচালনা এবং সামাজিক অংশগ্রহণমূলক কর্মকাণ্ড তারা সুচারুভাবে সম্পন্ন করছেন। তারা পুরুষের পাশাপাশি যেভাবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছেন, তেমনি ঘরে-বাইরে নিজেদের নিয়ে গেছেন সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেতা, স্পিকার ও সংসদ উপনেতা নারী। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ও মাঠপ্রশাসনে পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনী ও বহির্বিশ্বে প্রতিনিধিত্বমূলক কাজে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের ধারাবাহিক পদক্ষেপেরই প্রতিফলন।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'তার সরকার নারী উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে। ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌরসভায় সংরক্ষিত নারী আসন এক-তৃতীয়াংশে উন্নীত করাসহ এ সব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ জন নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।'
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারই সশস্ত্রবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ শুরু করে। মাঠপ্রশাসনে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়। এবারই প্রথম একজন নারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। প্রথম মহিলা বিচারপতিও ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেয়া হয়। নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার, সুরক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন এবং এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে রাষ্ট্র হবে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, যে রাষ্ট্রে বেগম রোকেয়ার বর্ণিত অবরোধবাসিনী নারী পাবে তার অধিকার, সমতা ও সমমর্যাদা। একজন স্ত্রীই পারেন স্বামীর সততার সহযাত্রী হতে, প্রকৃত সহধর্মিনী হতে।'
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা তার মায়ের কথা স্মরণ করে বলেন, 'ধন-সম্পত্তি, ক্ষমতা বা মন্ত্রীর স্ত্রী হওয়ার লোভ আমার মায়ের ছিল না বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন নির্লোভ থেকে দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে পেরেছিলেন।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্প-লাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেকোনো অপারেটর থেকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ১০৯২১ নম্বরে ডায়াল করে যেকোনো নারী অথবা শিশু নির্যাতন সম্পর্কে প্রতিকার পেতে অভিযোগ দিতে পারবেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ছাড়া, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ানস্টপ-ক্রাইসিস সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাভারের আশুলিয়ায় নারী পোশাককর্মীদের আবাসন সমস্যা নিরসনে ৮৩৬ শয্যার ভবন নির্মাণের পাশাপাশি শ্রমজীবী নারীদের আবাসন-সুবিধায় এক শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, হতদরিদ্র নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা-বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, বিধবা ও দুস্থ মহিলা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং বিত্তহীন মহিলাদের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি (ভিজিডি) অব্যাহত রাখা হয়েছে।'
নিজে নারী হিসেবে রাজনীতিসহ সব স্তরে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরে তা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন—তার সরকার কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন পাস করবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, 'যারা বলেন—মেয়েরা তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়বে, তারপর বিয়ে হবে, ঘর-সংসার দেখবে, সন্তান লালন-পালন করবে, তারা ইসলামের কতটুকু জানে?'
নারীদের অগ্রযাত্রার বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের অর্জনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 'এশিয়া কাপে ছেলেরা না পারলেও মেয়েরা বিজয় অর্জন করেছে। ক্রিকেটে ছেলেদের থেকে আমাদের মেয়েরা বেশি পারদর্শী। তারা আমাদের সম্মানটা রেখেছে পাকিস্তানকে হারিয়েছে, হোয়াইট ওয়াশ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়েও এগিয়ে।'
অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী কুটির শিল্পের বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল-ইসলাম, বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের আবাসিক প্রতিনিধি ক্রিস্টিন সুজান হান্টার প্রমুখ।