মো. রাশিদুল ইসলাম, গুরুদাসপুর (নাটোর) সংবাদদাতা
দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিল। সেই সাথে চলনবিল কেন্দ্রিক বড়াল, আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানীসহ ১৬টি নদ-নদী মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ফলে চলনবিল এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।
'ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া'র তথ্য অনুযায়ী, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কি.মি আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল থাকার কথা। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব ও ৮০র দশকে পদ্মার উত্স মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী, বিল, জলাশয়, খালগুলো পলি জমে ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছা সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ, নদী দখল করে বসতি ও দোকান পাট স্থাপন করায় নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নৌ-চলাচল। পানির স্তর নিচে নামতে নামতে এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন নদীগুলোতে ৪/৫ মাসের বেশি পানি থাকে না। শুকনো মওসুমে টিউবয়েল ও শ্যালোমেশিনে পানি পাওয়া যায় না। ফলে খাবার ও ফসলের খেতে সেচ দেয়ার পানি পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রায় ২৫ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌ-যান চলাচল করতো; কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর ২২২১ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে আর ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিলে ত্যাগ করে। অবশিষ্ট পলি নদ-নদীসহ চলনবিলে রয়ে যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি স্বার্থান্বেষী মহল স্থানীয় কতিপয় প্রশাসনিক কর্মকর্তার যোগসাজশে চলনবিলের প্রধান নদী বড়ালকে 'অবক্ষয়িত জলাশয়' ঘোষণা করে দখল করা শুরু করে। অন্যদিকে পানির অভাবে নদীতে জীবিকা করে খাওয়া মানুষগুলো বেকার হয়ে পড়েছে। স্থবিরতা নেমে এসেছে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে। আর নদী সংলগ্ন এলাকায় ফসলহানি, বদ্ধ পানিতে দূষণ-দুর্গন্ধ-রোগবালাই লেগেই রয়েছে। তারা বড়াল নদীকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন ও বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল জানান, চলনবিলের প্রধান সংযোগ নদী হচ্ছে বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে; কিন্তু ৮০র দশকে অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উত্স মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট এবং পাবনার চাটমোহরে ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে পুকুরে পরিণত হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি শিল্প কারখানার তরল বর্জ্যে এর পানি দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূমিদস্যুদের কবলে পড়েও বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীটি।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব ডিএম আলমগীর জানান, চলনবিল রক্ষায় বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও সর্বস্তরের মানুষ ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলন করছেন। নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীর সংসদ সদস্যরাও ওই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীতে জনদাবির মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড টাস্কফোর্স গঠন করে। এক পর্যায়ে টাস্কফোর্স এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়; কিন্তু বাস্তবে নদী উদ্ধারে তেমন কিছুই করা হয়নি।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রমজান আলী মোল্লা জানান, বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণে নদীর নাব্যতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ধারণা ঠিক নয়। গঙ্গা ব্যারেজের কারণে উজানে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বড়ালের নাব্যতা কমে গেছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। তবে নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে।
এ ব্যাপারে নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস বলেন, চলনবিলসহ বড়াল নদীকে রক্ষা করতে পারলে উত্তরের ৮ উপজেলার অর্ধকোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা অব্যাহত থাকবে। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাবে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। তাই নিজেদের স্বার্থে চলনবিল ও বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো রক্ষা করতে হবে।
এদিকে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে গত ১৪ মার্চ চলনবিলসহ মৃতপ্রায় নদ-নদীগুলো রক্ষায় গুরুদাসপুরের নন্দকুঁজা নদীর চাঁচকৈড় রসুনহাট পয়েন্ট থেকে ৫ কি.মি এলাকা জুড়ে সচেতনতামূলক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে 'চলনবিল রক্ষা কমিটি'। মানববন্ধনে সংগঠনের নেতারা চলনবিলের প্রধান নদী বড়ালকে দখলমুক্ত ও বাঁধ অপসারণ করে নদীটিকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার দাবি জানান।