আজ পয়লা বৈশাখ। লাল পেড়ে শাড়ি, চুলে লেইস ফিতা, পায়ে আলতা। খাবারের মেন্যুতে মাটির বাসনে পান্তা, ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা। ঘর আর অফিস সাজে মাটির পট, কলস আর মুখোশ আরও থাকে, ঝাড় আলপনা। সব মিলেই এই একটি দিন নগরের মানুষ বাঙালিয়ানায় নিজেকে সপে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল্লা খান বলেন, আমাদের আটপৌরে জীবনে অনেক উত্সব ছিল যা আজ নগরায়ন, শিল্পায়ন ও যান্ত্রিকতার কারণে হারিয়ে গেছে। বর্ষবরণ উত্সব সেই সব উত্সবকে ছাপিয়ে দিনের পর দিন প্রসারিত হচ্ছে। ঢুকে গেছে সকল পেশা শ্রেণির মানুষের জীবনে। তার অর্থ মানুষ তার শিকড়ের কাছে যেতে চায় সন্ধান করে শিকড়ের।
সাজ পোশাক : তাসলিমা হোসেন নদী এবং বিভা মোশাররফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। চারুকলার বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় আসবেন বলে শাড়ি কিনেছেন, তার সাথে মিলিয়ে শিশু একাডেমীর সামনে থেকে মাটির গয়না কিনলেন। নদী বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ১লা বৈশাখে শাড়ি পরেন। শাড়ির সাথে মিলিয়ে গয়না চুড়ি পরা হয়। আলতা পরার কথা তার তেমন করে মনে ছিল না। তাই পরবেন কিনা ঠিক করেননি। তার মাটির গয়নার দাম পরেছে ১২০ টাকা। দোকানদার আবু তাহের জানান, বৈশাখে তাদের যে মাটির পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে তার মধ্যে মেয়েদের গয়না অন্যতম। এখানে মাটির, কাঠের, সিরামিকের গয়না, চুড়ি, বালা পাওয়া যায় । দাম শুরু হয় বিশ টাকা থেকে। নদী আলতা না পরলেও রাশনা পরবে। রাশনা সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের শিক্ষার্থী। মার সাথে নিউ মার্কেটের নূর ফ্যাশন হাউজ থেকে ১২০ টাকায় আলতা কিনলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মৌমিতা রায় তাদের বিভাগের শোভাযাত্রায় পায়ে আলতা পরেই যাবেন। দোকানদার মোঃ মোস্তাফা জানান, ৭০-১২০ টাকায় তারা আলতা বিক্রি করছেন। বিয়ের মৌসুম ও বৈশাখে তাদের আলতা বেশি বিক্রি হয়। চারুকলার সামনে বসেছে কাঁচের চুুড়ির পসরা । এখানে ধুম পরেছে চুড়ি কেনার। চারুকলার বিথি শোভাযাত্রার মুখোশ তৈরির ফাঁকে চুড়ি কিনলেন দুই মুট ৪০ টাকা দিয়ে। এখানে ২০ থেকে ৫০ টাকায় চুড়ি পাওয়া যায়।
ঘর ও অফিস সাজাতে : নুসরাত জাহান আছেন বেঙ্গল কমিউনিকেশন লিমিটেডে। কাল ২রা বৈশাখ তাদের অফিসে হবে বর্ষবরণ উত্সব । তাই অফিস সাজাতে তিনি বেশ কিছু রঙিন মাটির হাড়ি, ফুলদানি, পোটার, ঝার ও কলস কিনলেন। নুসরাত জানান, গত বৃহস্পতিবারে অর্ডার করে গেছেন বলে তিনি কিছুটা সাশ্রয়ে এই পণ্য কিনলেন। যেগুলোর দাম আজ বেশ চড়া। তিনি ৬০ টাকা দরে রঙিন হাড়ি, ৩০০ টাকা দরে ফুলদানি, ঝার আর কলস কিনলেন ১০০-১২০ টাকায়। নুসরাত জানান, বৈশাখের প্রথমদিন তিনি পরিবারের সাথে বাড়িতে থাকেন এবং পান্তার আয়োজন করেন বলে এখান থেকেই মাটির বাসন কোসনও কিনলেন। এখানে মাটির সানকি (বাসন) ৮০-১২০ টাকা, জগ ১০০-১৫০ টাকা, চারি (গামলা) ৩০০ টাকা বাটি ৫০-৬০ টাকা। গ্লাস ৫০ টাকা।
খাবারে বাঙালিয়ানা : বৈশাখের প্রথম দিন পান্তা আর ভর্তা দিয়ে শুরু বাঙালি খাবার। তারপর দিনজুড়ে মেলায় ঘোরা আর সকলের ফিরে আসা মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, মুরলি নিয়ে। বাংলা একাডেমি বিসিকের সহযোগিতায় বৈশাখের প্রথম দিন থেকে দশ দিনের বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। যেখানে স্থান পায় আমাদের লোকজ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। মেলা সম্পর্কে সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, বাংলাভাষা সংস্কৃতি একই সূত্রে গাথা। বৈশাখী মেলার এই আয়োজন বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের উত্সব। নববর্ষের অসমপ্রদায়িক চেতনা মানুষের মনের গভীরে পৌঁছে দেয়। এই উত্সবকে কেন্দ্র করেই সব আয়োজন। আমরা মনে করি আয়োজনের ভেতর দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিবোধ অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
তিনি আরো বলেন, যখন সূচনা হয়েছিল তখন জনসংখ্যা কম ছিল, তথ্যপ্রযুক্তির দিকটি ছিল না। মিডিয়ার এত দরজা খোলা ছিল না। তখন বৈশাখী মেলা রমনার বটমূলে আয়োজিত হলে মানুষ তার শিকড় সন্ধানের অনুপ্রেরণা থেকে উত্সারিত হত। সময়ের পরিধিতে সেটাই বাস্তবতা ছিল। এখন মানুষ বেড়েছে সুযোগ বেড়েছে সেজন্য মনে হয় আয়োজন এখন বেশি। অধ্যাপক রফিকুল্লা খান বলেন, একদিনের উত্সবের মধ্যদিয়ে আমরা নিজেদের অস্তিত্বের সন্ধান পাই। নারীরা একদিন স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্বে ফিরে যায়। নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করে এই আমাদের আসল ঠিকানা যা পূর্ব-পুরুষরা ধারণ করতেন।