ভোর রাত। চারদিকে সুনশান নীরবতা। ময়না বেগম (২৯) তার মেয়ে নূরজাহান আক্তার স্বপ্না (১৩) ও ছেলে ইমনকে (৭) নিয়ে তখন গভীর ঘুমে। হঠাত্ স্বামী সুমন মিয়া (৩৮) বটি দিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীকে কোপাতে শুরু করেন। বাঁচাও বাঁচাও করে আর্তচিত্কার। ঘুম ভাঙ্গে মেয়ের। মাকে বাঁচতে এগিয়ে যায়। তার উপর একইভাবে চলে বটির আঘাত। প্রতিবেশিরা এগিয়ে আসে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তারাও ব্যর্থ হন। কোপে কোপে এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়েন ময়না বেগম ও মেয়ে স্বপ্না। আর এ দৃশ্য খুব কাছ থেকে অবলোকন করে দম্পতির ছেলে ইমন।
পারিবারিক কলহের জের ধরে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়েছে শুক্রবার ভোর রাতে নারায়ণঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল মুক্তিনগর এলাকায়। পুলিশ ঘাতক সুমন মিয়াকে গ্রেফতার করেছে। সুমন পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী। নিহত ময়নার বোন বেবী বেগম ও পুলিশের দাবি, সুমন মিয়া মাদকসেবী। এ ঘটনায় সুমন মিয়াকে আসামি করে নিহত ময়নার বোন ও বাড়ির মালিক শুক্কুর আলীর স্ত্রী হোসনা বেগম বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশের বুরো অব ইন্টেলিজেন্স-এর ( পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল পরির্দশন ও আলামত সংগ্রহ করেছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলাউদ্দিন জানিয়েছেন, পারিবারিক কলহের জের ধরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সুমন মিয়া পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে। একটু স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছালে তার কাছে থেকে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে।
প্রতিবেশীরা জানায়, ময়নার বড় বোন হোসনার টিনশেড বাড়িতে (এক রুম) গত দুই মাস আগে থেকে সুমন মিয়া স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন। এ বাসায় আসার পর থেকে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া হত। শুক্রবার রাতেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়রা এক পর্যায়ে ঘরের সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাত চারটায় সুমন ঘরে থাকা বটি দিয়ে ময়না ও স্বপ্নাকে এলোপাতাড়ি কোপালে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যায়। এ সময় ছোট ছেলে ইমন ভয়ে ঘরের এক কোণে আশ্রয় নেয়। ঘটনার পর থেকে সুমনও নির্বাক হয়ে গেছে। ভয়ে কোন কথাই বলতে পারছে না।
যেভাবে গ্রেফতার হয় সুমন মিয়া
প্রতিবেশী জোস্নার মা জানান, ঘটনার পর যাতে সুমন পালাতে না পারে এ জন্য ঘরের বাইরে থেকে তিনি নিজেই তালা লাগিয়ে দেন। এরপর তিনি মোবাইল ফোনে পূর্ব পরিচিতি রূপগঞ্জ থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর সুমন বাইরে বের হতে না পেরে এমনকি ছেলে সুমনের গলায় বটি ধরে তাকেও হত্যার হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায় ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এরপরই সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর সৈয়দ জহুরুল হক পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। পুলিশ সুমনকে বোঝানোর চেষ্টা করে। এসময় পানি খেতে চায় সুমন মিয়া। আর পানি নেয়ার জন্য জানালার কাছে আসতেই পুলিশ তার হাত টেনে ধরে জানালার গ্রীলের সঙ্গে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দেয়। পরে ঘরের একটি জানালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ মা-মেয়ের লাশ ময়না তদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি রক্তমাখা বটিও উদ্ধার করা হয়।
নিহত ময়না বেগমের আরেক বোন হাসিনা বলেন, সুমন মিয়া গ্রামের বাড়িতে কাপড় বিক্রি করার কাজ করত। সে নিয়মতিভাবে পরিবারকে খাবার খরচ দিত না। সপ্তাহে দুই/একদিন গ্রামের বাড়ি আখাউড়া থেকে এখানে আসত। কোন কোন সপ্তাহে আসত না। এ নিয়ে সুমনের সঙ্গে তার বোন ময়নার প্রায়ই ঝগড়া হতো। শুক্রবারও এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। এ ঘটনার জের ধরেই সুমন তার স্ত্রী ময়না ও তার মেয়ে স্বপ্নাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নিহত ময়নার বাবার বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার ছয়আনি গ্রামে। ঘাতক স্বামী সুমনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার রামধননগর এলাকায়।