জীবনের পদে পদে এই দেশে, এই নগরে বিড়ম্বনার শেষ নাই। কিন্তু পথ চলিতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পিপাসায় ছাতি ফাটিয়া গেলেও খাবার পানি পাওয়া যাইবে না— সে অবস্থা এইকালে প্রায় অকল্পনীয়। পথের পাশে যে কোনো চায়ের কিংবা মুদির দোকানে দেখিতে পাওয়া যায় স্বচ্ছ জারে টলমলে পানি। অনায়াসে পান করা যায় টাকায় এক গ্লাস। হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান সবখানেই এখন এই পানি। শহরের ছোট-বড় প্রায় সব অফিসেই জার ভর্তি পানি রাখা হয় তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। জার ভর্তি 'বিশুদ্ধ' পানি সরবরাহের প্রতিষ্ঠানও আছে এই শহরে অনেক। এইসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম করিয়া প্রত্যহ গ্রাহকদের নিকট পৌঁছাইয়া দেয় চাহিদামাফিক খাবার পানির জার। আর, সেই পানি নিশ্চিন্তে পান করিয়া চলিয়াছে দেশের মানুষ; নগরের মানুষ। কিন্তু হায়! তাহারা জানেন না, সরল বিশ্বাসে বিশুদ্ধ পানির নামে গিলিয়া চলিয়াছেন কী গরল! যেই জলে তৃষ্ণার্তের তিয়াস মিটিল, তাহা কেবলই এক গ্লাস শীতল পানি নাকি রোগজীবাণুতে কিলবিল করা ঠাণ্ডা তরল! ইত্তেফাকে প্রকাশিত সরেজমিন রিপোর্ট: বোতল কিংবা জারে ভরা 'বিশুদ্ধ' পানির এক উল্লেখযোগ্য অংশই অবিশুদ্ধ। পানি বিশুদ্ধকরণের কোনো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ছাড়াই জার ভরিয়া পানি সরবরাহ করা হইয়া থাকে গ্রাহকদের নিকট।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই-এর হিসাব অনুযায়ী মহানগর ঢাকায় প্রতিদিন বোতলজাত পানি বিক্রি হয় ৫ কোটি লিটার। নগরীতে পানির মোট চাহিদা ২০ কোটি লিটার। বাকী পনের কোটি লিটার পানির এক বৃহদংশ পূরণ করিয়া থাকে জারে ভরা তথাকথিত বিশুদ্ধ পানি। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছে, জারে ভরা পানি অনেকক্ষেত্রেই চূড়ান্তভাবে নিরাপদ নহে। ট্যাপের পানি সরাসরি জারে ভরিয়া সরবরাহ করা হয় গ্রাহকদের নিকট। এমনকি শৌচাগারের কল হইতে পানি ভরিয়া নগরবাসীর জল পিপাসা নিবারণের 'মহান দায়িত্ব' পালন করিয়া চলিয়াছে কোনো কোনো কোম্পানি। ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি যে খাওয়ার যোগ্য নয়, সেই কথা খোদ ওয়াসাও অস্বীকার করে না। লাইনের পানি না ফুটাইয়া পান করিবার কথা এই নগরের কোনো সচেতন মানুষ চিন্তাও করেন না। যেই সমস্ত এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করিয়া সরবরাহ করা হয়, সেই সব এলাকার পানি তুলনামূলক স্বচ্ছ হইলেও ওয়াসার অপরিচ্ছন্ন লাইনের কারণে তাহাও শেষাবধি আর বিশুদ্ধ থাকে না। আর, সেই পানি কিনা বোতলে এবং জারে ভরিয়া মানুষকে খাওয়ান হইতেছে! দাম দিয়া মানুষ গরল কিনিয়া গলাধকরণ করিতেছেন, ক্ষয় করিয়া চলিয়াছেন পরমায়ু। পানিবাহিত বিবিধ রোগ-ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি, জন্ডিস, কিডনির সমস্যাসহ নানান অসুখ-বিসুখের জীবাণু সংক্রমিত হইতেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নাই।
অতি পুরাতন কথা, স্বতঃসিদ্ধও বটে; পানির অপর নাম জীবন। সেই জীবন লইয়া এ কোন বর্বর খেলা শুরু হইয়াছে! ফলমুল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস সবকিছুতেই ভেজাল। ভেজাল আজ সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। আর যেই পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না সেই পানি লইয়াও প্রতারণা চলিতেছে। ইহার কি কোনো প্রতিকার নাই! যাহারা এই জীবনবিনাশী প্রতারণা করিতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বিলম্ব করিবার সামান্যতম অবকাশও নাই। সেই সঙ্গে দরকার নাগরিক সচেতনতা। ঘরের বাহিরে পানি গ্রহণ করিতে হইলে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত কর্তব্য।