এডেন হ্যাজার্ড, ভিনসেন্ট কোম্পেনি, রোমেলো লুকাকু, কেভিন মিরালাস, আদনান ইয়ানুজি, থিব্যু কোর্তোয়া...। না, এখানে ইউরোপের কোনো সেরা একাদশের নাম বলা হচ্ছে না। না জানলে হঠাত্ বোঝা কষ্ট, ইউরোপ মাতানো এই খেলোয়াড়রা আসলে একটা জাতীয় দলের হয়ে খেলেন— বেলজিয়াম!
ইউরোপিয়ান লিগের এই অত্যন্ত কার্যকর সব ফুটবলারদের উপস্থিতিই আসলে এবার বিশ্বকাপের 'ডার্ক হর্স' করে তুলেছে বেলজিয়ামকে। দল হিসেবে তেমন কোনো ঐতিহ্য নেই, নেই দরে মেসি-রোনালদো-নেইমার। কিন্তু এই এক ঝাক অতি কার্যকর ফুটবলারকে আপনি কী করে অস্বীকার করবেন! ফিফার বর্তমান র্যাংকিং-এ ১১ নাম্বার স্থানধারী বেলজিয়ামের বিশ্বকাপগামী স্কোয়াডের ১২ জনই ইংলীশ প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়ার। ইউরোপের এই অভিজ্ঞতাই এবার বিশ্বকাপে কাজে লাগাতে চায় বেলজিয়াম।
১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে ২০০২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত টানা ছয় বার অংশগ্রহনের পর এবার বেলজিয়াম দল এবার ব্রাজিল যাচ্ছে ১২ বছর পর বিশ্বকাপ খেলতে। এবারের আগের তিনটি বিশ্বকাপে চুড়ান্ত পর্বেই যেতে পারে নি বেলজিয়াম। এই মৌসুমে ক্লাবে খেলোয়ারদের পারফর্মেন্স বিচারে এ বিশ্বকাপেই তাদের অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইউরাপের বিভিন্ন শীর্ষ লীগের অনেক গুরুত্বপুর্ন খেলোয়ার এবার বেলজিয়াম দলে।
পুরো ফুটবল পৃথিবীকে চমকে দিতে প্রস্তুত অধিনায়ক কোম্পেনির নেতৃত্বে হাজার্ড, লুকাকু, মিরালাসরা। প্রত্যেক পজিশনেই তাদের পরীক্ষিত ও প্রমানিত সব খেলোয়ার।
বেলজিয়ামের আক্রমণভাগে তিন তারকা লুকাকু, হ্যাজার্ড ও মিরালাসের পরিসংখ্যানই কথা বলবে তাদের হয়ে। এভারটনের হয়ে লুকাকু গোল করেছেন ১৫টি, ৬টি গোলে সহায়তা করেছেন। একই ক্লাবের হয়ে কেভিন মিরালাস ৮টি গোল করেছেন এবং গোলে সহায়তা করেছেন ৮টিতে। আর আছেন হ্যাজার্ড। যিনি চেলসিতে ১৮টি গোল করার পাশাপাশি ৭টি অ্যাসিস্ট করেছেন!
হ্যাজার্ডের তারকাখ্যাতির কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ফ্রেঞ্চ ক্লাব লিলে থেকে নিজ ক্লাবে নিয়ে আসার জন্যে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড সহ ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব গুলো রীতিমতো যুদ্ধে লেগে পড়ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হ্যাজার্ড চেলসিকেই নিজের ঠিকানা হিসেবে বেছে নেন। দুই উইঙ্গেই খেলতে পারা, মার্কার কে ফাঁকি দিয়ে ম্যাচের যেকোন মুহুর্তে ফ্ল্যাঙ্ক পরিবর্তন করা, বক্সের বাইরে থেকে দু পায়েই বাঁক খাওয়ানো জোরালো শট নেওয়ার সমান দক্ষতা—এসব গুনাবলী চেলসির এই খেলোয়ারকে বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর উইঙ্গারে পরিনত করেছে। হোসে মরিনহোর অধীনে খেলে প্রিমিয়ার লীগের এইবারের সেরা উদীয়মান ফুটবালারের পুরষ্কার প্রাপ্তি, তার সফলতার স্বীকৃতি।
সি,আই,এ,এস নামক সুইজারল্যন্ড ভিত্তিক এক প্রািতষ্ঠানের জরিপে পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে হ্যাজার্ডই এখন মেসি, রোনাল্ডো, সুয়ারেজের পর পৃথিবীর চতুর্থ মূল্যবান খেলোয়ার। এই বিশ্বকাপে এদের সবাইকে ছাড়িয়ে হ্যাজার্ড আলো ছড়ালে অবাক করার কিছু থাকবে না।
যদিও মৌসুমের শেষ দিকে এটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালে হাজার্ড রক্ষনাত্নক ভুমিকার দায়িত্বগুলো ঠিকমতো পালন করতে পারে নি বলে অভিযোগ তোলেন চেলসি কোচ হোসে মরিনহো। আর বেলজিয়ামের সাবেক ফরোয়ার্ড মার্ক ডিগ্রাইস ও হ্যাজাডের্র সমসাময়িক পারফরম্যান্সের মুল্যায়নে মরিনহোর সুরে বলেছেন, 'বেলজিয়ান কোচের উচিত হবে হ্যাজার্ড যদি আশানুরুপ খেলতে না পারে তবে তার বিকল্প চিন্তা করা। অতো আয়েশি না খেলে রক্ষনেও হ্যাজাডের্র মনযোগ দেয়া উচিত ।'
তবে মার্ক উইলমটস এখনো হ্যাজাডের্র উপরই পূর্ণ আস্থা রাখছেন। এছাড়াও মৌসুমে লুকাকু এবং মিরালাসের অসাধারন পারফরম্যান্স, এভারটনের মতো কম বাজেটের ক্লাব কে প্রিমিয়ার লীগের মতো প্রতিদ্বন্ধিতাপুর্ণ লীগে পঞ্চম হতে সহায়তা করেছে। দুই উইঙ্গে মিরালাস এবং হ্যাজার্ড আর স্ট্রাইকার লুকাকু প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের দারুন পরীক্ষা নিবে সেটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
হ্যাজার্ড এবং মিরালাসের নিখুঁত ফ্রিকীক প্রতিপক্ষের গোলপোষ্টে বরাবরের মতোই আতঙ্ক ছড়াবে। এছাড়াও কর্নার, ইন্ডিরেক্ট ফ্রিকীক থেকে মাথা ছুঁয়ে গোল করার খেলোয়াড়ের অভাব ও এই স্কোয়াডে নেই। হ্যাঁ, এই টিমেই কোম্পেনী, ইয়ান ভার্তোনহেনরা আছেন যারা কর্নার থেকে মাথা ছুয়ে বল প্রতিপক্ষের জালে পাঠাতে পারদর্শী। ২০১২ সালে ম্যানসিটির শিরোপা জয়ে ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ম্যাচে কোম্পেনির হেডের সেই গোল রীতিমতো ফুটবল রুপকথার ই অংশ হয়ে আছে।
টটেনহামের মাঝমাঠের কারিগর মোসা ডেম্বেলে, ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের মারোন ফেলেইনি এবং রাশিয়ান ক্লাব জেনিতের অভিজ্ঞ খেলোয়ার এক্সেল উইটসেলে সমন্বয়ে গড়া মিডফিল্ড আক্রমনে ভারসাম্য ধরে রাখতে এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে প্রতিপক্ষের আক্রমনে প্রতিবন্ধকতা দেয়ার কাজ ভালো মতো নিয়মিতই করছে ।
রক্ষনে আর্সেনালের অভিজ্ঞ সেন্টার ব্যাক টোমা ভের্মেলেন, টটেনহামের পরীক্ষিত ইয়ান ভার্তোনহেন, এতলেটিকো মাদ্রিদের টবি আল্ডেরহোয়ের্ল এবং ম্যানসিটির অধিনায়ক কোম্পেনি নিয়ে ঘঠিত জমাট ডিফেন্স কে ভেদ করা যেকোন আক্রমনভাগের জন্যই দুরূহ হবে। এর মধ্যে কোম্পানি যেভাবে সিটিকে গত কয়েক বছর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দুটো শিরোপা এনে দিয়েছেন; তাতে এই ফুটবলার এখন 'মোস্ট ওয়ান্টেড সিনিয়র' হয়ে পড়েছেন! আর সাইডবেঞ্চে টটেনহামের নাসের চাদলির, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আদনান ইয়ানুজি, চেলসির সাবেক খেলোয়াড় কেভিন দি ব্রুইন এর মতো উদিয়মান তারকাদের সামর্থ্য কোচের মনে আত্ববিশ্বাস জোগাবে- এটাই স্বাভাবিক।
তারকা আসলে কোথায় নেই তাদের?
গোলবারের নিচে থাকছেন এই সময়ের সেনসেশন কোর্তোয়া। চেলসি থেকে গত তিন মৌসুম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ধারে খেলছেন। কেনো তাকে বিশ্বসেরা তিন গোল কিপারের একজন ধরা হয় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে গতো দু বছরের সাফল্যে সেটা প্রমানিত। ২০১২-১৩ মৌসুমে ২৭ ম্যাচ নিজের গোল বার অক্ষত রেখে লা লীগার সেরা গোলকিপারের খেতাব অর্জন করেছিলো। এই মৌসুমেও এতলেটিকো মাদ্রিদ কে লা-লীগা চ্যাম্পিয়ন ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে নিয়ে যেতে তাঁর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিলো। কোর্তোয়া এখন এতোটাই গুরুত্বপূর্ন যে চ্যাম্পিয়নস লিগে তাকে নিজেদের বিপক্ষে না খেলানোর চেষ্টায় মাথার ঘাম ফেলেছিল চেলসি! গোলকিপারের জায়গা নেওয়ার জন্য সাইড বেঞ্চে প্রস্তুত আরেক বিশ্বমানের গোলকিপার লিভারপুলকে ইংলীশ লিগে দ্বিতীয় স্থান পেতে গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখা সিমোন মিনুলেট। সরাসরি ম্যাচে না খেললেও দ্বিতীয় গোলকিপারের সামর্থ্য ও দক্ষতা কিভাবে একটা টিমের সাফল্যে প্রভাব ফেলতে পারে সেটা স্প্যানিশ পেপে রেইনা দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে প্রমান রেখেছেন।
এই দলটির কোচের দায়িত্বে আছেন মার্ক উইলমটস যিনি বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের হয়ে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা (৫ গোল) এবং সর্বশেষ গোলদাতা। ২০০২ বিশ্বকাপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়সুচক গোলের মালিক। ব্যক্তিজীবনে রাজনীতিবিদ এই সাবেক খেলোয়ারকে বেলজিয়াম ফুটবলের আদর্শও ধরা হয়। তাঁর চার টি বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা হয়তো নিজের দেশকে টুর্নামেন্টে সফলতা পেতে কাজে দিবে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো উনি বিশ্বের অন্যতম ফুটবল মস্তিষ্ক ডিক এডভোকেট এর সহকারী থেকে জর্জ লিকেন্সের বিদায়ের পর এই দায়িত্বে এসেছেন। উইলমটসের ভাষাতেই, ডিক এডভোকেট এই দলটাতে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হওয়ার বীজ বুনে গেছেন এবং মাঠের খেলার সঙ্গে মাঠের বাহিরেও যে খেলোয়ারদের পর্যাপ্ত সুবিধাদি নিশ্চিত করলে মাঠের পারফর্মেন্সে প্রভাব ফেলে সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এইচ গ্রুপে আবারো রাশিয়া, আলজেরিয়া এবং দক্ষিন কোরিয়াকে টপকে উইলমটস বেলজিয়ামকে কতটুকু সাফল্য দিতে পারে সেটাই এখন দেখার ব্যাপার।