আর সব ঈদের মতো এবারের ঈদেও ঘরমুখো লঞ্চযাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। দুইশ' থেকে ৫ শত টাকা, আবার কারও কারও কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে কেবিন এর বেলায় বাড়তি ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। তবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে লঞ্চ সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকার নির্ধারিত ভাড়াই নিচ্ছেন তারা। যাত্রীরা সেটাকেই বাড়তি ভাড়া মনে করে ভুল করছে।
গত শুক্র ও শনিবার সরেজমিনে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদপুরগামী লঞ্চ ময়ূর-২ এর ডেকে যাত্রী প্রতি ভাড়া ৭০ থেকে ৮৫ টাকা হলেও ঈদকে কেন্দ্র করে নেওয়া হচ্ছে দেড় থেকে দুইশ' টাকা। আবার ১ম শ্রেণীর চেয়ারে আগের ১৬০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর চেয়ারে ১শ' টাকার টিকিটে ২৫০ টাকা হাতে লিখে আদায় করা হচ্ছে। লঞ্চের মাস্টার মোস্তফা কামাল দাবি করেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়াই আদায় করছেন তারা। অথচ মো. আমিন নামে এক কেবিন যাত্রী জানান, তার কাছ থেকে ৭শ' টাকার কেবিনে ২৫শ' টাকা নেওয়া হয়েছে। আবার ৪শ' টাকার কেবিনে দুই হাজার টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানান মনির হোসেন নামে অপর এক যাত্রী। চাঁদপুরগামী লঞ্চ ঈগল-১ ঘুরেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। ঢাকা থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব তুলনামূলক কম হওয়ায় এখানে ভাড়ার হেরফের একটু কম বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে চলাচলকারী লঞ্চ পূবালী ঘুরে দেখা যায়, পটুয়াখালীর গলাচিপা পর্যন্ত আগের ২শ' টাকার স্থলে এখন ৩শ' থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যদিও লঞ্চটির কেরানি এসএম রানা বেশি ভাড়া আদায়ের কথা অস্বীকার করেন।
ঢাকা-বরিশাল রুটের ভান্ডারিয়াগামী লঞ্চ অগ্রদূত প্লাস, রাজদূত-৭ এ ডেকের দেড়শ' টাকার ভাড়া এখন ৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে যার কাছে যেমন সম্ভব আদায় করা হচ্ছে বলে জানালেন শফিক নামে এক যাত্রী। অগ্রদূত প্লাসে যাত্রী উঠিয়ে দিতে আসা অভিভাবক নওয়াব আলী জানান, তার কাছে ডেকের ভাড়া ৩শ' টাকা চেয়েছেন লঞ্চের কর্মীরা।
লঞ্চ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া নেওয়া হতো ৮শ' টাকা, ডাবল কেবিন ১৫শ' থেকে ১৬শ' টাকা, আর ভিআইপি কেবিন আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়া সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার টাকা, ডাবল কেবিন ২ হাজার টাকা আর ভিআইপি বুকিং সাড়ে ৩ হাজার টাকা রেখেছেন বলে দাবি করেন সুন্দরবন-২ এর সুপারভাইজার মিলন। একটু পরেই লঞ্চের কেরানি রুহুল আমিনকে কেবিন বুকিং রেট জিজ্ঞেস করলে তিনি সিঙ্গেল আর ডাবল কেবিন রেট সুপারভাইজারের সমান বললেও খাতায় দেখা গেল, ভিআইপি কেবিন ৫ হাজার টাকায় বুকিং দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা-বরিশাল রুটের কীর্তনখোলা-১ এর কেরানি বোরহান উদ্দিনও দাবি করলেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়াই আদায় করছেন তারা। অগ্রদূত প্লাস ও রাজদূত-৭ এর যাত্রী রিয়াজ (২৬) ও রেজোয়ান (২২) জানালেন, সেখানে সিঙ্গেল কেবিনের ৮শ' টাকার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত।
তবে ডেক আর কেবিনে সরকারি ভাড়াই নেওয়া হচ্ছে দাবি করে অগ্রদূত প্লাস এর কেরানি মো. হারুন অর রশিদ বলেন, সবগুলো কেবিন বুকিং শেষ। বাড়তি টাকায়ও কেবিন মিলবে না। এসময় তার পাশে থাকা লঞ্চের আরেক কর্মীর সঙ্গে কানে কানে কথা বলার পর তিনি বলতে শুরু করলেন, স্টাফদের একটা কামরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে দু'জন যাওয়া যাবে। তার জন্য ২ হাজার টাকাই দিতে হবে।
ঢাকা-বরিশাল-ঝালকাঠি রুটের এমভি টিপু লঞ্চের কর্মচারী জাহাঙ্গীর জানান, তাদের কেবিন বুকিং শেষ। তবে ২ হাজার টাকায় স্টাফদের থাকার কামরা দেওয়া যাবে। পরে ওই লঞ্চের যাত্রী ইমাম হোসেন (২৭) বলেন, ভাই, আপনি বুঝেন নাই, সিঙ্গেল কেবিন ২ হাজার টাকার বেশিতে বুকিং দেওয়ার লোভে ওই টাকায় যাত্রীদের স্টাফ কামরার কথা বলা হচ্ছে। বুকিং শেষ না হলে যাদের কাছ থেকে স্টাফ কামরা বুকিং নেওয়া হচ্ছে তাদের সিঙ্গেল কেবিন দেওয়া হবে। বুকিং শেষ হওয়ার কথা বলে মূলত বেশি টাকা কামানোর ধান্দা করা হচ্ছে।
পারাবত-২ এর কেরানি বাবুল হোসেন দাবি করেন, তাদের কেবিন বুকিং শেষ হয়েছে। কোন বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই লঞ্চের এক কর্মচারী জানান, বুকিং শেষ হওয়ার কথা বললেও ৮শ' টাকার কেবিন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দিলে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এছাড়া সুরভী-৮, সুন্দরবন, পারাবত-৭ সহ ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী আর সব লঞ্চেও একই চিত্র বলে জানান ওই রুটের নিয়মিত যাত্রীরা।
বাড়তি ভাড়া ও কেবিন বুকিং বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা'র সহ-সভাপতি মো. সাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, আগে অনেক কম ভাড়া আদায় করা হতো। কিন্তু এখন সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তাই যাত্রীদের কাছে এ ভাড়া বাড়তি মনে হতে পারে। কেবিন বুকিং শেষ হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বাড়তি ভাড়ায় কেবিন দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
এ সব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ এর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন উপ-পরিচালক মো.সাইফুল হক খান ইত্তেফাককে বলেন, সদরঘাট টার্মিনালের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। টার্মিনালে যাত্রী নিরাপত্তায় একাধিক ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।