রফতানিমুখী খাতসহ উত্পাদনমুখী সকল কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন খাতে পর্যাপ্ত মাত্রায় যোগান সহায়তা দিয়ে প্রবৃদ্ধিকে জোরালো গতিশীল করা হবে। এজন্য নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে আগেকার ধারাবাহিকতায় ভোক্তা মূল্যস্ফীতি পরিমিত ও স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে নতুন মুদ্রানীতিতে মুদ্রা ও পুঁজিবাজারে স্বস্তিকর স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হয়েছে। এতে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন প্রয়াসে আস্থা ও উত্সাহ যোগানে অবদান রাখবে।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আতিউর রহমান মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে বড় ধরনের সারপ্রাইজ থাকছে না। মুদ্রানীতির ভঙ্গিটিও হবে বিগত ষান্মাষিকের মুদ্রানীতির মতোই সতর্ক ও বিনিয়োগ-বান্ধব। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী, ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাসান জামান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজি হাসানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে অন্য ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকরাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
মুদ্রানীতি মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, বিনিয়োগের জন্য একটা স্বস্তিকর পরিবেশ দরকার। আমরা সেটা তৈরি করতে চাই। সর্বত্রই একটা স্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলে বিনিয়োগ বাড়বে, দেশ উন্নত হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। তিনি বলেন, পদ্মাসেতুসহ দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প আসছে। এর বাইরেও জাপান, চীনসহ অনেকেই বিনিয়োগ করবে। অবকাঠামো হলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ বাড়বে। বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব ঋণ দেয়া হবে সেসব ঋণের গুণগত মান ঠিক রাখার বিষয়ে ব্যাংকারদের সতর্ক থাকতে হবে।
পুঁজিবাজার সহায়ক নীতি বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, আমরা একটি গতিশীল পুঁজিবাজার চাই। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সহায়ক নীতি থাকবে। এবারের মুদ্রানীতিতে এমন কোন নীতি গ্রহণ করা হয়নি যার মাধ্যমে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ৯০০ কোটি টাকার পুন:অর্থায়ন তহবিলের সময়মতই ছাড় করাসহ অন্যান্য সহায়ক নীতি নেয়া হচ্ছে।
গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ঋণ ও আর্থিক বাজারের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা, সুষ্ঠুতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগের মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা কার্যক্রমগুলোর বিভিন্ন দিকে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের অপসারণের বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের নতুন সংশোধনীতে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া এখতিয়ার প্রয়োগ করে আর্থিক খাতকে ইতিমধ্যেই একটি সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষার্ধে প্রাক-নির্বাচনকালীন লাগাতার অবরোধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালায় সাময়িকভাবে আনা নমনীয়তা জুন ২০১৪ নাগাদ শেষ হয়েছে। বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থার আলোকে এসব ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে বিভিন্ন মাত্রায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। এদিকে আগের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণ মতই খাদ্য বহির্ভূত ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল। মূলত খাদ্য বহির্ভূত ভোক্তা মূল্যস্ফীতির নিম্নগামীতাই গড় ভোক্তা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। তাই খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী রাখতে সরবরাহ চ্যানেলগুলো মসৃণ ও কৃষি ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতির ঘোষণায় আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ যোগানের ঊর্ধ্বসীমা ধরা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। আর এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সীমা ধরা হয়েছে ১৪ শতাংশ। অবশ্য বিদেশি বিনিয়োগসহ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের ঊর্ধ্বসীমা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ আর আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। এবার রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি হার ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ১৬ শতাংশ রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে তার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করতে অন্যান্য বারের মত এবারও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যাংকার, প্রাক্তন গভর্নর, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রাক্তন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হয়েছে।