সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ ছিল ঈদের সব আগেই গার্মেন্টসে বেতন-ভাতা পরিশোধের। সে অনুযায়ী প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়ন হলোনা। রাজধানী বাড্ডার তুবা গ্রুপের পাঁচটি কারখানার এক হাজার ৬০০ শ্রমিক পেলেন না ঈদের বোনাস। এমনকি পেলেন না তাদের বেতনও। চোখ থেকে অশ্রু ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারছেনা তারা। তবে শ্রমিকরা এখনো অনড় বেতন-বোনাস না নিয়ে তারা কারখানা থেকে নড়বে না। এ জন্য শ্রমিকরা আজ সোমাবারও কারখানার সামনে অবস্থান নেবার কথা জানায়।
আাাজ রবিবার পর্যন্ত গার্মেন্ট শিল্পে সামগ্রিকভাবে ৮৫ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে বলে বিজিএমইএ ও শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন। তবে আজ সোমবার ৫ শতাংশের মত গার্মেন্টসে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ শতাংশ কারখানার শ্রমিককে বেতন-বোনাস ছাড়াই শুণ্য হাতে ঈদ করতে হবে। বেতন-বোনাস না হওয়া কারখানার মধ্যে সাব কন্ট্রাকটিংয়ের কারখানাই রয়েছে বেশি।
অবশ্য ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেয়া এবং গার্মেন্টসের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে গতকাল বিকাল ৪টায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে জরুরী সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও পরে তা বাতিল করে বিজিএমইএ। কি কারণে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে সে বিষয়ে বিজিএমইএ কিছুই জানায়নি। তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, বেতন না পাওয়া শ্রমিকদের রোষানলে পড়ার ভয়েই সংবাদ সম্মেলন বাতিল করেছে বিজিএমইএ।
এ প্রসঙ্গে জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, বিজিএইএর নেতারা প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন আজ তুবা গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়া হবে। কিন্তু তা দিতে না পারায় শ্রমিকরা আবারও বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করতে পারে-এ ভয়ে বিজিএমইএ নেতারা পালিয়েছেন। অবশ্য বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম ইত্তেফাককে বলেন, কারো ভয়ে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়নি। অনিবার্য কারণেই তা বাতিল হয়েছে।
শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়া প্রসঙ্গে বিজিএমইএ অন্য এক নেতা বলেন, তুবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেন জেলে থাকায় কারখানার শ্রমিকরা বেতন-বোনাস পাননি। আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছিলাম ঈদের আগে যাত এক মাসের বেতন ও বোনাস দেয়া যায়। কিন্তু সরকার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় এবং ব্যাংক ঋণ না দেয়ায় শেষ পর্যন্ত আর বেতন-বোনাস দেয়া সম্ভব হলো না। তবে আমরা এখনো চেষ্টা করছি অন্তত শ্রমিকদের হাতে বাড়িতে আসা-যাওয়ার মতো কিছু টাকা হলেও দেয়ার। সে ক্ষেত্রে একেক জন শ্রমিককে ১ হাজার বা ২ হাজার করে টাকা দেয়া হতে পারে। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে চপা দিয়ে মালিক পক্ষই এ টাকা দিতে রাজি হয়েছে। তবে কখন দেওয়া হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, বেতন-বোনাসের দাবিতে তুবা গ্রুপের শ্রমিকরা গত এক মাস থেকেই আন্দোলন করে আসছে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আন্দোলনও তীব্র হয়। কয়েক দফা এই কারখানার দেড় হাজারের অধিক শ্রমিক কখনো বাড্ডার কারখানা ঘেরাও করে আবার কখনো কারওয়ানবাজারস্থ বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করেছেন। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার বিকাল থেকে তিন মাসের বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা দেলোয়ার হোসেনের শাশুড়ি ও শ্যালককে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় মালিক পক্ষ এক মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার কথা বললেও শ্রমিকরা তা না মেনে আন্দোলন চালিয়ে যান। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে দেলোয়ার হোসেনেরে শ্যালক রুবেল হোসেনকে বেতন-ভাতার অর্থ জোগাড়ের জন্য কারখানা থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেন শ্রমিকরা। তিনি বের হয়ে যমুনা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পযন্ত যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় ঋণ দেয়া যাবে না। কারণ হিসাবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, তুবা গ্রপের মালিক জেলে থাকায় ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না।
তারপরও বিজিএমইএর তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল আজ বেতন-বোনাস দেয়া হবে। তিন মাস ধরে বেতন না পাওয়া এসব শ্রমিকরা বড় আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু দুপুরে জানানো হয়, ব্যাংক ঋণ না দেয়ায় বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্রমিকরা। ওই কারখানার শ্রমিকরা বলেন, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা কারখানা ভবন থেকে যাবো না। আমরা জানতে পেরেছি সামান্য কিছু টাকা দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত কি দেয় নাকি কিছুই জুটবে না তা না দেখে আর ঘরে ফিরছি না।
বেতন-ভাতা দেয়ার দিক থেকে পিছিয়ে সাব কন্ট্রাক্ট কারখানায়:
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এর সদস্য নয় এমন সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানা গুলোতে বেতন-ভাতা পরিশোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। যদিও সব কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য নির্ধারিত তারিখ ছিল ২৬ জুলাই। ঈদের আগে এসব কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে কিনা সে বিষয়ে শংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয় এমন কারখানার সংখ্যা প্রায় ৮০০ বলে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের হিসাবে পাওয়া গেছে। এ সব কারখানার মধ্যে গতকাল অনেক কারখানা বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে। তবে যতদূর জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ৩০০ কারখানায় ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়নি।
এ দিকে শিল্প পুলিশ সূত্র বলছে, তাদের নজরদারিতে থাকা ৩ হাজার ৬৫৫ কারখানার মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় ১৮৩ কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে না পারার আশঙ্কা রয়েছে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, সাব-কন্ট্রাক্ট করে, এমন প্রায় সাড়ে ৩০০ কারখানার শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। একই অনিশ্চয়তা রয়েছে সরাসরি রফতানি করে এমন প্রায় অর্ধশত কারখানায়। যদিও আজকের মধ্যে সব কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল মালিকপক্ষ।
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, সারা দেশের সাড়ে তিন হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর বাইরে আছে সংগঠনের সদস্য নয়, এমন অনেক কারখানা। এ কারখানাগুলোর ওপর সরকারের তদারকি প্রত্যাশা করছি।
গত মাসে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক প্রতিবেদনে ১২৪টি কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে তুবা গ্রুপের নামও ছিল। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় আরো ৮৭টি কারখানার নাম।
ইঅ/চৌফে/শ৮২৯/০৯:৫০পিএম