ঢাকা বেতারের অনুরোধে ১৯৪১ সালে ' রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গানটি লিখে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সলো দলীয়সহ বিবিধ প্রকরণে গানটি সব চ্যানেল ব্যবহার করে। অথচ এই গানটির বাণীর সঙ্গে কী প্রবল বৈসাদৃশ্য আমাদের তথাকথিত সংস্কৃতিবানদের আচরণে। গানটির অস্থায়ীতেই আছে 'তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন, আসমানী তাগিদ' তা আসমানী তাগিদে না হলেও জমিনের তাগিদে আমরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে আসি বটে, নগরীর লক্ষ স্কয়ার ফিটের শপিং মলগুলোতে তো অসত্ উপায়ে অর্জিত অর্থগুলো বিলিয়ে দিয়ে আসেন নগরের রাঙা রাজকন্যা আর রাজপুত্ররা। ঈদের বিশেষ কটি দিন গণমাধ্যমের পর্দাও তারাই সরগরম করে রাখবেন। কেননা আগ্রাসী পুঁজির রকমারি এই দুনিয়ায় তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বেঁধে ফেলেছেন ব্র্যান্ডিং ইমেজে। যে ভাষায় তারা কথা বলেন তা বাংলা ভাষা-ই কিনা বুঝতে কষ্ট হলেও তবু সেই ভাষা এবং বাচনভঙ্গিই ব্র্যান্ড।
তাদের লক্ষ টাকার জুতার গ্ল্যামার দেখে পর্দার এ পাশে থাকা সম্মিলিত মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাস যোগ করলে তা একটা ছোটখাটো ভূমিকম্পের সমান-ই হতো বোধ হয়। উপায়হীন অসহায় ভোক্তাদের ভূমিকা নিতে হবে এখানে। দেখতে হবে দরিদ্র এই দেশেও পায়ের নখ এবং চুলের রঙের জন্য এক শ্রেণীর অবৈধ বিত্তের অধিকারীরা কি পরিমাণ খরচ করেন। আর গণমাধ্যম এইসব অশ্লীল বিত্তের প্রদর্শনীতে কী ভীষণ নিবেদিত! উত্সবকালীন গণমাধ্যম তার ভোক্তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয় অমুক ব্র্যান্ডের চুলের রঙ আর তমুক ব্র্যান্ডের গাড়ির মডেলের মালিক না হলে আপনার জীবন ষোলোআনাই মিছে !
যিনি একেবারে কিছু দেখবেন না বলে অন্ধের ভূমিকায় থাকেন তারও অস্বীকারের জো নেই যে, আমাদের সমাজ জীবনের পদে পদে বিরোধ বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। সাধারণ সময়ে বৈষম্যের সেই বিশাল ফোকর কোন রকম ঢেকে ঢুকে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু উত্সবের সময়টাতে তার নির্লজ্জ নগ্নতাকে আর ঢেকে রাখা যায় না। এইসব আছে বিবিধ বিলাসী পণ্যের রমরমা প্রচার।এ দরিদ্র দেশে এত ইমপালসিভ বায়িং সত্যিই অশ্লীল। একজন মানুষের ক'টা পোশাকের দরকার হয়? ক'জোড়া জুতা লাগে? যারা লক্ষ লক্ষ টাকা একটি পোশাকের পেছনে খরচ করেন তাদের মনে কি কোন প্রশ্ন জাগে না? নজরুলের ওই বিখ্যাত গানটির অন্তরায় বলা হয়েছে, তোরে মারলো ছুঁড়ে জীবন জুড়ে, ইট পাথর যারা, সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ। নজরুল মহত্তোম মানুষ ছিলেন। তাঁর পক্ষে এরকম লেখা খুবই সম্ভব। কিন্তু যারা আমাদের জীবন জুড়ে পাথর ছুঁড়ে মারছে তাদেরকে নিয়ে প্রেমের মসজিদ গড়ে না তোলাই ভালো। আর গড়ে তুললেও টিকবে না।
এই পাথর ছুঁড়ে মারার বিষয়টিকে প্রতীকী অর্থে বিশ্লেষণ করুন, দেখবেন, কত বিচিত্র কায়দায় তারা আমাদের জীবনে পাথর ছুঁড়ে মারছে। এই যে ঈদ কেনাকাটার বাহারি রঙিন দিনগুলোতে পত্রিকার শিরোনাম হয় বিদেশি পোশাকের দাপট হুমকিতে দেশীয় তাঁতবস্ত্র। বিদেশি পণ্যের হুলস্থূল কেনাকাটায় যারা দেশি তাঁতকে যারা হুমকির মুখে ছুঁড়ে দেন তারাই পাথর ছুঁড়ে মারা পার্টি। শুধুমাত্র দেশীয় তাঁতবস্ত্রকে পাথর ছুঁড়ে মেরেই তারা ক্ষান্ত দেন না, দাপিয়ে বেড়ান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার বাজারেও। যে সংস্কৃতির দাপটে দীর্ঘশ্বাস ফেলা মধ্যবিত্ত কিশোরীও 'পাখি' পোষাক না পেলে আত্মহত্যা করে বসে। তার আর দোষ কী? জনজীবনে প্রভাব সৃষ্টিকারী গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই প্রমাণ করে ছেড়েছে যে, 'পাখি' পোশাক না পেলে জীবনে আর থাকলো-ই বা কী? আত্মহত্যাকারী কিশোরীর মনস্তত্ত্ব পাঠ করলেই বোধহয় আঁচ করা যেত কোন সংস্কৃতি আমাদের কাঁধে চেপে বসতে চাইছে। যে পোশাক শ্রমিকরা বেতন বোনাস না পেয়ে সুরম্য পোশাক কারখানার সামনে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে তারা বেতনই বা পাবে কবে? আর বাজারই বা করবে কবে? এর কোন উত্তর কেউ দেবে না।
বেতন বোনাস না পাওয়ার এই পুনরাবৃত্তির চক্র থেকে কি মুক্তি নেই পোশাক শ্রমিকদের? জীবনানন্দ কটাক্ষ করে লিখেছিলেন অপরের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া প্রিয় কোন মুখ নেই। এই অপরের মুখ ম্লান করে দেয়া লক্ষ টাকার 'পাখি' পরিহিত-রা ঈদ উদযাপনের নামে যা করে তা এক ধরনের ইয়ার্কির সংস্কৃতি। একদল পাখি সেজে উড়াল দেবে হিল্লি-দিল্লী আরেক দল পাখি কিনতে না পেরে লাশ কাটা ঘরে ঠাঁই নেবে, এমন অসাম্যের দেশে ঈদের শুভেচ্ছা মশকরা হয়েই ফেরত্ আসে। দুঃখিত নজরুল, আমরা পাখির মধ্যেই বিলীন হয়েছি, নিজেকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারিনি। জীবনের এক ইঞ্চি জায়গাতেও আমরা আসমানী তাগিদ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমরা জমিন তাগিদ সর্বস্ব ভোগী এক জীব!
লেখক :কথাশিল্পী