রেখার জ্বর সারেনি। কমলা বললেন— ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
তুমি চলে যাও, বললেন নীলকান্তবাবু।
তুমি যাও না, আমার রান্না বান্না পড়ে রয়েছে।
নীলকান্তবাবু বললেন— আমি অফিস ফেলে কীভাবে যাই। তুমি রান্নার কাজটা শেষ করে চলে যাও। আমাকে এককাপ চা দিয়ে যেও।
কমলা একটু বিরক্ত হয়ে দুই চুলার একটাতে মগে এককাপ পানি আর আরেকটাতে কড়াই বসিয়ে এককাপ পরিমাণ তেল দিলেন। চা আর রান্না একসাথে হবে বলে। একটু পর তেল ফুটতে থাকলো, কিন্তু পানি ফুটলো না। রেখা রান্নাঘরে এসেছিলো, উদ্দেশ্য মাকে বলা এককাপ চা খাবো। মগে চায়ের পানি দেখে ভাবলো ওর জন্যই বানানো হচ্ছে। বাবাকে বললো— কড়াইতে তেল ফুটতে থাকলো, কিন্তু পানি ফুটলো না কেন ? দুটো তো একসাথেই বসানো হয়েছে।
পানির আপেক্ষিক তাপ বেশি, তাই পানি ফুটতে বেশি তাপের প্রয়োজন, বেশি দেরি হচ্ছে।
আপেক্ষিক তাপ কী ?
আপেক্ষিক তাপ হলো, কোনো বস্তুর একটা তাপীয় বৈশিষ্ট্য। এক কিলোগ্রাম ভরের একটা পদার্থের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়াতে যে তাপ লাগে, সেটি ঐ পদার্থের আপেক্ষিক তাপ। পানির আপেক্ষিক তাপ প্রতি কেজিতে চার হাজার দুইশ জুল।
তার মানে ? বললো রেখা।
তার মানে হলো, এক কিলোগ্রাম পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়াতে চার হাজার দুইশ জুল তাপের প্রয়োজন। সেই তুলনায় তেলের আপেক্ষিক তাপ কম। কাজেই কম তাপেই তেল গরম হয়ে যায় এবং ফুটতে থাকে। আবার গরম হলে পরে দুটো একসাথে নামালে দেখবি তেল আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কারণ তেলের আপেক্ষিক তাপ কম। কাজেই কম তাপ বর্জনেই তাপমাত্রা কমে গেছে।
কমলা ইতোমধ্যেই মগে আরো একটু পানি দিয়েছিলেন। এ থেকে দুইকাপ চা বানিয়ে বাবা মেয়েকে দিলেন। নীলকান্তবাবু চায়ের প্লে¬ট হাতে করে কিচেন থেকে চলে এলেন। একটু পরে রেখাও চলে এলো। ওর হাতেও চায়ের কাপ। সে গরম চা খেতে পারছে না। প্লেটে ঢেলে নিয়ে চুমুক দিচ্ছে।
তাপ বিকিরণের হার বস্তুর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের ওপর নির্ভরশীল। ক্ষেত্রফল বেশি হলে তাপ বিকিরণ বেশি হবে, কম হলে বিকিরণ কম হবে। কাপের চেয়ে প্লে¬টের ওপর অংশের ক্ষেত্রফল বেশি বলে প্লে¬টে ঢেলে নিলে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়।
বুঝেছি— বললো রেখা। তাপ বিকিরণের হার কি শুধু পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের ওপরই নির্ভর করে ?
না। এটি নির্ভর করে বস্তুর পরিপার্শ্বের তাপমাত্রা ব্যবধানের ওপর, বস্তুর আপেক্ষিক তাপের ওপর।
কীভাবে বুঝবো ? বললো রেখা।
পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল তো তোকে বুঝিয়েই দিলাম। এখন পরিপার্শ্বের তাপমাত্রার ওপর কীভাবে নির্ভর করে সেটি বলছি। ধর এককাপ চা চুলা থেকে নামিয়ে আনলি একদম শীতের দিনের কনকনে ঠাণ্ডায়। তখন তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে না ?
হ্যাঁ, বললো রেখা।
তখন চায়ের তাপমাত্রা আর পরিপার্শ্বের তাপমাত্রা ব্যবধান, মানে আশেপাশের তাপমাত্রার ব্যবধান বেশি। কাজেই তাপ বিকিরণের হার বেশি।
আর আপেক্ষিক তাপের ওপর কীভাবে ?
সেটি তো বললামই। তেল আর পানি গরম অবস্থায় একসাথে নামালে আগে তেল ঠাণ্ডা হবে। কারণ এর আপেক্ষিক তাপ কম। এটি হলো নিউটনের শীতলীকরণ সূত্র।
কোনটি ? বললো রেখা।
ঐ যে, কোনো বস্তুর তাপ হরাসের হার, অর্থাত্ শীতলীকরণের হার এর আপেক্ষিক তাপের সমানুপাতিক, পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক, এর পরিপার্শ্বের তাপমাত্রা ব্যবধানের সমানুপাতিক।
আচ্ছা বাবা— বললো রেখা, তুমি বললে পানির আপেক্ষিক তাপ চার হাজার দুইশ জুল পার কেজি পার কেলভিন। এটি তো আন্তজার্তিক পদ্ধতিতে। তাহলে সিজিএস পদ্ধতিতে কত হবে ?
নীলকান্তবাবু বললেন— সিজিএস পদ্ধতিতে পানির আপেক্ষিক তাপ এক ক্যালরি পার গ্রাম পার ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মানে কী ?
মানে হলো, এক গ্রাম পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াতে এক ক্যালরি তাপের প্রয়োজন।
এই তো সমস্যা। বললো রেখা, ক্যালোরিটা কী ?
ও, ক্যালরি বলা হয়নি। ক্যালরি হলো তাপের একক।
তাপের একক না জুল ?
হ্যাঁ, জুল। আগে ছিলো ক্যালরি।
এক ক্যালরি কতটুকু তাপ ?
এক ক্যালরি হলো, এক গ্রাম পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াতে যে তাপ লাগে।
তাহলে ক্যালরি আর জুলের কী সম্পর্ক ? বললো রেখা।
ক্যালরি আর জুলের সম্পর্ক হলো— নীলকান্তবাবু বললেন, এক ক্যালরি সমান চার দশমিক দুই জুল। এখন জুল দিয়ে তাপ নাকি কাজ এটি বুঝবো কীভাবে? রেখা সন্দেহ প্রকাশ করছে।
নীলকান্তবাবু বললেন— এটি বুঝিয়েছেন বিজ্ঞানী জেমস প্রেসকট জুল একটি সূত্রের সাহায্যে।
কোন সূত্র ? বললো রেখা।
সূত্রটি হলো কাজ দ্বারা তাপ উত্পন্ন করলে বা তাপের সাহায্যে কাজ করতে গেলে কাজ ও তাপ পরস্পর সমানুপাতিক।
মানে ?
মানে হলো যতটুকু তাপ, সেই অনুপাতে কাজ। একে একটা ধ্রুবক দিয়ে গুণ করে সমান করা যায়। এই ধ্রুবককে বলা হয় তাপের যান্ত্রিক সমতা বা তাপের যান্ত্রিক তুল্যাংক বা জুলের ধ্রুবক।
রেখা বললো— ও, একে জুলের ধু্রবক বলা হয় কারণ এই সূত্রটি বিজ্ঞানী জুল আবিষ্কার করেছেন। তাঁর নামানুসারেই এর নাম। এই ধ্রুবকের মান কতো ?
নীলকান্তবাবু বললেন— এর মান চার দশমিক দুই জুল পার ক্যালরি।
মানে কী ?
মানে হলো এক ক্যালরি তাপ দিয়ে চার দশমিক দুই জুল কাজ করা যায়।
এর মধ্যে কমলা কিচেন থেকে এসে দেখলেন নীলকান্তবাবু রেখার সাথে গল্প জমিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন— বাহ! বাপ মেয়ে ফিজিক্সের গল্প শুরু করলে আর জ্বর থাকে না, না ?
রেখা, নীলকান্তবাবু দুজনেই চুপ করে গেলেন। কমলা বললেন— তুমি না অফিস যাচ্ছো।