অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

১৪ আগস্ট ১৯৭৫। এমএ শেষ পর্বের ক্লাস শেষ করে বিকালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে আসছিলাম। সাথে নিয়ে ফিরছিলাম তুমুল উত্তেজনা ও আবেগ। কারণ পরের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন। তার আগমন উপলক্ষে ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকসহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে ছিল উত্সবের আবহ। ছিল সাজ সাজ রব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতিকে সংবর্ধনা দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ক্যাম্পাসে অবস্থিত বিভিন্ন ভবন-প্রাঙ্গণ সেজেছিল বর্ণিল সাজে। এর একটি বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান চ্যান্সেলর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। ১৪ আগস্ট রাতেও বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে শিক্ষক, ছাত্রনেতা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। অপেক্ষা ছিল শুধু রাত পোহাবার, কিন্তু সেই রাতের অন্ধকার যখন কাটল, তখন বাঙালি জাতি তাদের জাতীয় জীবনে দেখল অন্ধকারের ঘনঘটা। ১৫ আগস্ট ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নিভে গেছে বাঙালির প্রাণপুরুষের জীবন প্রদীপ। রেডিও-টিভিতে এবং লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সংবাদ। সেদিনের সূর্য উদয়ের আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও জাতির ইতিহাসের শোকাবহ সেই সংবাদ এসে পৌঁছায়। মুহূর্তেই বিষাদ আর বিষন্নতায় ছেয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান শাসন আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন তিনি। প্রশাসন থেকে তাকে অভিভাবক প্রত্যায়িত মুচলেকা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করা বঙ্গবন্ধুর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। তিনি কর্মচারীদের আন্দোলনকে ন্যায়সঙ্গত বলে মুচলেকা দেননি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এই শিক্ষাঙ্গনে আর তার ফেরা হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিক আগমন স্বাভাবিকভাবেই বিপুল উদ্দীপনা তৈরি করে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মাঝে। জাতির জনকের আগমন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে মানপত্র রচনা করে। তৈরি করে এর কাস্কেট, রুপার তৈরি ক্রেস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম সংবলিত একটি ক্রেস্ট। সুন্দর অক্ষরখচিত নিমন্ত্রণপত্র বণ্টন করা হয়। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দে (টিএসসি) সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই রাতের অন্ধকারে ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু আসতে পারলেন না তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের গোটা আয়োজন পরিণত হলো ভাঙা হাটে। সারাদেশের মত আমরাও নিমজ্জিত হলাম প্রবল শোকে। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই পত্রিকা আর পাঠকের হাতে পৌঁছায়নি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের হস্তক্ষেপে।
১৪ আগস্ট বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় যাওয়ার আগেই জেনে নিয়েছিলাম, টিএসসিতে মূল অনুষ্ঠানের কথা। সেখানে মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ঐ বিভাগও তিনি পরিদর্শন করবেন। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে ছাত্রনেতারাও বিপুল প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ প্রস্তুতির অগ্রভাগে ছিলেন শেখ কামাল। তখন তিনি সদ্যবিবাহিত। বঙ্গবন্ধু বরণের প্রস্তুতি নিতে নিতে ১৪ আগস্ট রাত গভীর হয়ে যায়। শেখ কামাল তাই সে রাতে হলে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু অন্য ছাত্রনেতারা তাকে বাসাতেই চলে যেতে বলেন, তিনিও চলে যান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের মত তিনিও ঘাতকের বুলেট থেকে রেহাই পাননি। ১৪ আগস্ট রাতে যে বিপুল আগ্রহ নিয়ে ১৫ আগস্টের অপেক্ষায় ঘুমাতে যাই। পরদিন ভোরবেলা তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। প্রথমে লোকমুখে ও পরে রেডিওতে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সংবাদ। সেদিন এক অনন্ত বিস্ময় ও শোক ভর করে। বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশ শোকে নিমজ্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর ছাত্রদের মাঝে একই সাথে শোক ও ক্ষোভ দানা বাধে। ক্ষোভের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশও ঘটতো। কিন্তু সামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনাসহ ঢাকা শহরের রাস্তায় নেমে পড়ে। তাই তাত্ক্ষণিকভাবে প্রকাশ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না হলেও ছাত্র-শিক্ষকদের মনে অবৈধ দখলকারীদের মনে ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার প্রমাণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে তারা কতটুকু ভালোবাসে।
১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে লেখা তার স্বাক্ষরিত মানপত্র থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষভাবে মর্যাদা দিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে ঘোষণা করার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই সেই ঘোষণা আসত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উচ্চতর মর্যাদা প্রাপ্তি আর ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্রকে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দিতে না পারার এ বেদনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরকাল বইবে। এটি আমাদের জন্য চিরকালের অপ্রাপ্তি, নিঃসীম শূন্যতা।
শ্রুতি লিখন: মাহবুব রনি