আমার ভাই ও বোনেরা
আজ ২৬ মার্চ ১৯৭৫ সাল। ৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছিল। সেদিন রাতে বিডিআর-এর ক্যাম্পে, পুলিশ ক্যাম্পে, আমার বাড়িতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চারদিকে আক্রমণ চালায় ও নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক শক্তি নিয়ে। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়েছিলাম; ৭ মার্চ আমি তাদের প্রস্তুত করে দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, সেই মুহূর্তে আবার আমি ডাক দিয়েছিলাম যে- আর নয়, মোকাবেলা করবো। আমি সবার বন্ধুত্ব কামনা করি। পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নাই; কিন্তু আমার সম্পদ তাকে দিতে হবে। আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই, করো সাথে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই।
আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে আসলাম— তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমার বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে ৭ কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। গত তিন-চার বছরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে। ২২ কোটি টাকার মতো বিদেশ থেকে হেল্প আমরা পেয়েছি। সেজন্য যারা আমাদের সাহায্য করেছেন— সে সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্রকে আমরা ধন্যবাদ জানাই; কিন্তু আর একটি কথা, অনেকে প্রশ্ন করেন, আমরা কি করেছি? আমরা যখন ক্ষমতায় আসলাম, দেশের ভার নিলাম, তখন দেশের রাস্তা-ঘাট যে অবস্থায় পেলাম, তাকে রিপেয়ার করার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনী নাই, প্রায় ধ্বংস করে গেছে, পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভালো করতে কী করি নাই? আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না, আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না, বৈদেশিক ডিপার্টমেন্ট ছিল না, প্লানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। এখানে কিছুই ছিল না— তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হলো। যারা শুধু কথা বলেন তারা বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করে বলুন- আমরা কি করেছি। ১ কোটি লোককে ঘর-বাড়ি দিয়েছি। রাষ্ট্রের লোককে খাওয়ানোর জন্য বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়েছে। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে।
আমাদের কর্তব্য মানুষকে বাঁচানো। চারদিকে হাহাকার, স্বাধীনতা পাবার সাথে সাথে সমস্ত জিনিসের দাম আস্তে আস্তে বেড়ে গেল। সমস্ত দুনিয়া থেকে আমাদের কিনতে হয়। খাবার কিনতে হয়, ওষুধ কিনতে হয়, তেল কিনতে হয়। আমরা তো কলোনি ছিলাম, দুইশ বছর ইংরেজদের কলোনি ছিলাম। ২৫ বছর পাকিস্তানের কলোনি ছিলাম। আমাদের তো সবকিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়; কিন্তু তারপরেও বাংলার জনগণ কষ্ট স্বীকার করে কাজ করতে আরম্ভ করেছেন; কিন্তু তারা এগুবার দেয় না, কাজ করতে দেয় না। আর একদল বিদেশে সুযোগ পেল, তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলো।
আমি প্রোগাম দিয়েছি। আজকে আমাদের কাজ কি? আজকে আমাদের সামনে অনেক কাজ। আমি সকলকে অনুরোধ করবো। আপনারা মনে কিছু করবেন না, আমার কিছু উচিত কথা কইতে হবে। কারণ আমি কোনদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। সত্য কথা বলার অভ্যাস আমার আছে। মিথ্যা বলার অভ্যাস আমার নাই; কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় কথা বলবো— বন্যা হলো। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম। ৫৭ হাজার লঙ্গরখানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সাহায্য নিয়েছি মানুষকে বাঁচাবার জন্য। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কি স্বাধীনতা? আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুইটা কথা ছিল— রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়— সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়— সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে- সে দুর্নীতিবাজ।
আজকে জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। আমার চেয়ে অধিক কে জানতে পারে? বাংলার কোন থানা আমি ঘুরি নাই, বাংলার কোন জায়গায় আমি যাই নাই, বাংলার মানুষকে আমার মতা কে ভালো করে জানে? আপনারা দুঃখ পান, না খেয়ে আছেন, আপনাদের গায়ে কাপড় নাই, আপনাদের শিক্ষা দিতে পারছি না; কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস খাদ্য।
একটা কথা বলি আপনাদের কাছে, সরকারি আইন করে কোনদিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয়— জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একমাত্র অনুরোধ আপনাদের কাছে, সেটা হলো এই— আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলবো, বাংলার জনগণের এক নম্বর কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উত্খাত করতে হবে। ভয় নাই, কোন ভয় নাই, আমি আছি। ইনশাআল্লাহ আপনাদের উপর অত্যাচার করতে দিব না; কিন্তু আপনাদের গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে পারে কে? ছাত্র ভাইরা পারে, পারে কে? যুবক ভাইরা পারে। পারে কে? বুদ্ধিজীবীরা পারে। পারে কে? জনগণ পারে। আপনারা সংঘবদ্ধ হন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য।
দ্বিতীয় কথা, আপনারা জানেন— আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়; কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে ডবল ফসল করতে পারবো না, দিগুণ করতে পারবো না? আমি যদি দিগুণ করতে পারি- তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না, ভিক্ষা করতে হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা, কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই— জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না। ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না। আমি পাগল হয়ে যাই চিন্তা করে। এ বছর ১৯৭৫ সালে আমাকে ৬ কোটি মণ খাবার আনতে হবে। কি করে মানুষকে বাঁচাবো।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না— আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হলো ৩ নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো— দুর্নীতিবাজ খতম কর, দুই নম্বর হলো— কারখানায় ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ান। তিন নম্বর হলো— পপুলেশন প্ল্যানিং। চার নম্বর হলো- জাতীয় ঐক্য। বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়। একজন ডাক্তার হতে সোয়া লাখ টাকার মতো খরচ পড়ে। একজন ইঞ্জিনিয়ার করতে ১ লাখ-সোয়া লাখ টাকার মতো খরচ পড়ে। বাংলার জনগণ গরিব; কিন্তু এরাই ইঞ্জিনিয়ার বানাতে টাকা দেয়, মেডিক্যালের টাকা দেয় একটা অংশ। আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইদের, যে আপনার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে, তা শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়— শুধু আপনার ছেলে-মেয়েদের দেখার জন্য নয়। দিয়েছে তাদের জন্য আপনি কাজ করবেন, তাদের সেবা করবেন বলে। তাদের আপনি কি দিয়েছেন? কি ফেরত দিয়েছেন? কতটুকু দিচ্ছেন?