আগের প্রজন্ম মোটামুটি চিনলেও তারপরের প্রজন্মের কাছে শহীদ মিরাজ শুধুই সাইনবোর্ডে জোলানো একটি নাম। তারা জানেনা তার বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ী জীবন কিংবা যোদ্ধাজীবনের একটি বর্ণও। জানবার জন্যও যে খুব বেশি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বা প্রচেষ্টা রয়েছে তেমনও না। একাত্তরের এই তরুণ প্রতিনিধি ধ্যান জ্ঞান সব কিছুই উত্সর্গ করেছিলেন তার পোলভল্টের বাঁশের লাঠিতে কিন্তু মার্চের বিভীষিকাময় সে রাতের পর কোথায় যেন হারিয়ে গেলো এই প্রতিভাবান এ্যাথলেট। ক্রীড়াঙ্গনে সেই উত্সগীকৃত প্রাণ, সুঠাম মাংস পেশীর মধ্য থেকে জন্ম নিলো এক দুরন্ত মুক্তিযোদ্ধা নাম এ কে এম মিরাজউদ্দিন।
অসাধারণ গড়নের সুদর্শন মিরাজের প্রিয় ইভেন্ট ছিল পোলভল্ট, হার্ডলস এবং লং জাম্প। ১৯৬৩ সালে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে এ তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলেন মিরাজ। ১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাতেও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং লং জাম্পে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ১০ম পাকিস্তান ওলিম্পিকে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন মিরাজ। ১৯৭০ সালে একই সালে করাচী হকি কাব মাঠে অনুষ্ঠিত ১২তম পাকিস্তান জাতীয় গেমসে তত্কালীণ পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাদের সেরা এ্যাথলেট হিসেবে মিরাজকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিরাজউদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ। কিন্তু সে সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। ২৫ মার্চের কালো রাত্রি সব কিছু উল্টে দেয়। কালমাত্র বিলম্ব না করে ঢাকা ছেড়ে আসেন হরিরামপুর গ্রামে। গ্রামে বসে সংগঠিত করতে থাকেন তরুণদের সাথে নিজের ছোট ভাই একেএম সিরাজউদ্দিনকেও। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিক। বিধবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছোট ভাই সিরাজসহ সোজা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হালিমের কাছে হাজির হয়ে যান মিরাজ। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি তিনি। পোলভল্টের বাঁশের পোল ধরা হাতে আঁকড়ে ধরেন অস্ত্র। একটির পর একটি গেরিলা যুদ্ধ, আসতে থাকে জয়। ২ নভেম্বর ১৯৭১ যুদ্ধজয়ের নেশায় উন্মত্ত মিরাজদের উপর দায়িত্ব পড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার। রাতের আঁধারে শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু বিধি বাম। ব্রিজে ডিনামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান মিরাজ। তাঁকে চিনতে দেরী হয়নি হানাদারদের। বন্দী মিরাজকে মানিকগঞ্জের ক্যাম্পে না নিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার আর্মি হেড কোয়ার্টারে। এখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে নির্মম নির্যাতন। হাজারও নির্যাতনের মুখে মিরাজের কাছ থেকে সহযোদ্ধাদের কোন প্রকৃত খবর বের করতে পারেনি তারা। এরই এক পর্যায়ে আহত মিরাজকে দেখানো হয় পাকিস্তান টেলিভিশনে। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দুষ্কৃতি হিসেবে, জোর করে বলানো অনেক কথা। তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল, স্বর্ণরাঙা সকালে মিরাজের ভাইসহ পরিবারের সবাই ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ তাদের কাছে নির্মম সত্যটি জানিয়ে দেন, 'মিরাজ তাদের কাছে নেই। ৮ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর ডিরেক্টর মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে মুক্ত করে পাকবাহিনীর জীপে করে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আজও কোন খোঁজ মেলেনি মিরাজের। আলবদর বাহিনী ক্রীড়াঙ্গনের এই নক্ষত্রকে চিনতো বলেই তাকে নিভিয়ে দেবার কথা ভুলেনি। স্বাধীনতার ৪২ টি বছরেও মিরাজের পরিবার খুঁজে পায়নি তার লাশের ঠিকানা, কবরের কোন চিহ্ন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে জন্মে ছিলেন এই তরুণ তুর্কী। মাত্র ১১ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবা শরীফ উদ্দিন আহমেদকে। বিধবা মা মোসাম্মত্ হাজেরা খাতুন তাঁকে তিল তিল করে বড় করেছেন মানুষের মত করে। লেখাপড়ার হাতে খরি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি পেরিয়ে হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুলে। এখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। এরপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার এতবছর পরও জাতীয়ভাবে তো নয়ই তাঁর জন্মভূমি মানিকগঞ্জেও আলাদা করে খুব একটা তাঁকে স্মরণ করা হয়নি। মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামফলকে শহীদ তপনের সাথে যৌথভাবে আছে তাঁর নাম শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম হিসেবে। প্রাপ্তি বলতে ঐটুকুই।