হঠাত্ করেই সহিংস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। বিদায়ী বছরের শুরু থেকেই রাজপথে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। চলেছে শেষ পর্যন্ত। থামেনি এখনও। পুলিশের গুলিতে বিরোধী জোটের আন্দোলনকারীদের যেমন মৃত্যু হয়েছে, তেমনি চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ককটেল-হাত বোমা হামলার ঘটনার তো কোনো হিসাব নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে এ বছর জীবন দিতে হয়েছে ৪৯৩ জনকে। আহত হয়েছেন ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ। ঘটনার সংখ্যাও প্রায় সাড়ে ৮শ। দিনের পর দিন এই ধরনের পরিস্থিতি দেখতে দেখতে এখন ক্লান্ত দেশের মানুষ। সবাই এখন শান্তি চান, যেকোনো অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতি চান।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে ৪৯৩ জনকে। ৮৩১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আহত হয়েছেন আরও ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর এর মধ্যে ৯৫ জন আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২২ জন মারা গেছেন। শুধুমাত্র সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের এই হিসাবে রাখা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো মৃত্যুকে এই হিসাবে রাখা হয়নি।
পুলিশ সদর দফতর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে কতজন মারা গেছেন তার কোনো পৃথক হিসাব রাখা হয় না। তবে পুলিশের হিসাবে গেল বছর বিভিন্নভাবে খুন হয়েছেন ৩ হাজার ৯৮৯ জন। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে খুনের সংখ্যা ৪২৮ ও ৪২১ হলেও অন্য মাসগুলোতে চারশ'র নিচেই ছিল। এরমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় কতজন মারা গেছে তা তারা বলতে পারেনি। তবে ২৫ নভেম্বরের পর থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা পৃথক করে রেখেছে পুলিশ সদর দফতর। সেখানে বলা হয়েছে এই কয়দিনে ১১৮ জন মানুষকে রাজনৈতিক কর্মসূচি সংশ্লিষ্টায় জীবন দিতে হয়েছে। আর কর্মসূচি বর্হিভূত ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের।
রাজনৈতিক সংঘাতে এত প্রাণহানি সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০১ সালে। ওই বছর ৫২৩ জন মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারান। আর গত ২৩ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন অন্তত আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক সংঘাত। বিরোধী জোট রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। আর জামায়াত ও শিবির আন্দোলন করেছে যুদ্ধপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য। গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবিতে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধেই তাদের আন্দোলন ছিল বেশি। বছরের শুরুতেই ২৯ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। ওই দিনই হরতাল দেয় জামায়াত, প্রাণ যায় তিনজনের। সেই থেকে শুরু। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হলে দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহেরর ওই সহিংতায় ১৮ জেলায় ৭৭ জন প্রাণ হারান বলে তথ্য সংগ্রহ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তাদের হিসাবে বড় ধরনের সহিংসতা সেই থেকে শুরু।
বছরের মাঝ পথে ৫ মে মতিঝিলে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম নামে চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি ধর্মীয় সংগঠন। সমাবেশ করে তাদের ওই দিনই ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও রাতে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। এর আগে দিনব্যাপী পুলিশের সঙ্গে হেফাজত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। মতিঝিল-পল্টন এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হেফাজত নেতাকর্মীরা। রাতে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় র্যাব ও পুলিশ। এই সহিংসতায় সব মিলিয়ে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও হেফাজত বা অন্যদের হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার জন্য অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলাও হয়েছে। এছাড়া পুরো বছরের প্রতিমাসেই কাউকে না কাউকে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু হঠাত্ লাগাম ছাড়িয়ে গেছে বছরের শেষে এসে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে টানা আন্দোলন শুরু করে বিরোধী জোট। শেষ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা হলে ২৫ নভেম্বর থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ওই দিনের পর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১২১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এই অবস্থার মধ্যে বছরের শেষ সময়ে এসে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১০ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, চলে কয়েক দিন ধরে। এতে জীবন দিতে হয় বহু মানুষকে। এখনও চলছে সেই সহিংসতা। আর শেষই বা কবে হবে? এই প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। তবে দ্রুত এর একটা শেষ চান সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
পুলিশ সদর দফতরের এক হিসাবে দেখা গেছে, গেল বছর হরতাল অবরোধের সহিংসতায় সারাদেশ পুলিশের ১৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আর এ সময় আহত হয়েছেন পুলিশের প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। এরমধ্যে যশোরে নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল কাজী জহুরুল হক, গাইবান্ধার বাবুল মিয়া, হযরত আলী, তোজাম্মেল হোসেন, নীলফামারীতে খাজা নাজিম উদ্দিন আকন্দ, চট্টগ্রামে আবু তারেক, ঝিনাইদহে জিএম ওমর ফারুক, রংপুরে মোজাহার আলী ও খুলনায় মফিজুর রহমান। আর হেফাজতের হামলায় রাজধানীতে মারা যায় এসআই শাহজাহান, গোপালগঞ্জে নায়েক ফিরোজ খান ও কনস্টেবল মোহাম্মদ জাকারিয়া। আর আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৫৭ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে অনেকেই সারা জীবনের জন্য বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব।
সর্বশেষ রাজশাহীতে অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন ৮ জন পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে সিদ্ধার্থ শেষ পর্যন্ত ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান। ৬ মাস আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন পুলিশেরই আরেকজন সদস্যকে। একের পর এক হামলার ঘটনায় পুলিশের মনোবল কি ভেঙে পড়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ইত্তেফাককে বলেন, 'অনেক পুলিশ সদস্যকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে। এতে পুরো বাহিনীর মনোবল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পুলিশের উপর হামলা মানে রাষ্ট্রের উপর হামলা। আর পুলিশ সদস্যরা রাষ্ট্রের জন্য সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েই এই পেশায় নিয়োজিত হন। এতে কাউকে জীবন দিতে হলেও পুলিশ সদস্যরা নিজের দায়িত্ব পালনে পিছুপা হন না। আর পুলিশের উপর যারা হামলা চালাচ্ছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘকালীন সংকটের মধ্যে চলে যাচ্ছি আমরা। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের রাজনৈতিক নেতারা একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারবেন ততই মঙ্গল। তা না হলে সামনের সময়েও আমাদের সাধারণ মানুষকে এভাবে আরও জীবন দিতে হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।' প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা মানসিকতা বদলে জনগণের কথা মন থেকে ভাবলে দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ছবি শামসুল হায়দার বাদশা