শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন। তার বিরুদ্ধে বজ্র কঠিন প্রতিবাদ, তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলা। পরিণামে ২৭ বছর অন্ধকার কারাগারে বাস। নিজ দেশে থেকেও প্রিয়তম স্ত্রী থেকে পরবাসী। অবশেষে তার কাছে শ্বেতাঙ্গ সরকারের মাথানত করা এবং মুক্তি লাভ। মুক্তি পেয়ে সেই শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং অনেকের আপিত্ত সত্ত্বেও এক শ্বেতাঙ্গকে দেহরক্ষী নিয়োগ। এই বাক্যগুলো পড়ে হয়তো অনেকের মনে হতে পারে এগুলো কার গুণ? এসব গুণের অধিকারী কোনো মানুষ পৃথিবীতে আছে কি! যে পৃথিবী হিংসা, বিদ্বেষ আর হানাহানিতে ভরপুর। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাই যেন নিয়ম হয়েছে প্রভাবশালী দেশের জন্য। সেখানে এ রকম মানুষ থাকাটা দুরূহ ব্যাপারই বটে। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি ছিলেন। তবে এখন তার শারীরিক উপস্থিতি পৃথিবীতে আর নেই। তিনি বর্ণবাদ, অমানবিকতা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রোলিহলাহলা, নেলসন, মাদিবা, তাতা, খুলু এবং ডালিভুঙ্গা। তিনি সারা বিশ্বের শিক্ষাগুরু। যার নামই একটি দেশের ইতিহাসকে তুলে ধরে। এই বছর অনেক ঘটনাই হয়তো সাড়া ফেলেছে। তবে ম্যান্ডেলার মৃত্যুর মতো নয়। কেবল এ বছর নয়, গত কয়েক প্রজন্মেও এ ধরনের সাড়া ফেলানো ঘটনা ঘটেনি। কারণ মানবতার প্রতীক ম্যান্ডেলার স্মরণানুষ্ঠানে ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনসহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদও। তার মৃত্যু কাঁদিয়েছে পুরো পৃথিবীকে।
গণমাধ্যমে সবেচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া ব্যক্তি ম্যান্ডেলা গত ৫ ডিসেম্বর চলে গেছেন এক অজানা দেশে। তবে তার গোষ্ঠীর মতে, তিনি গেছেন তার পূর্বপুরুষদের কাছে যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন। ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালে ২৫ মার্চ। ছিলেন ২৭ মার্চ পর্যন্ত। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে বের হয়ে স্বাধীনতার পথ বের করা কখনোই সহজসাধ্য নয়। তিনি বাংলার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চেয়েছিলেন বাংলার বন্ধু হতে।
অসুস্থ ম্যান্ডেলাকে নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিলেন। সবার মধ্যে একটা উত্কণ্ঠা কাজ করছে, বর্ণবাদবিরোধী নেতা ম্যান্ডেলা চলে গেছেন। কিন্তু দেশে বর্তমানের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিরাজমান ঐক্য কী আদৌ থাকবে? না কি পূর্বের মতোই আবার বর্ণ বৈষম্যের মধ্যে পড়বে দেশটি। দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার কী উন্নতি হবে না কি অবনতির দিকে যাবে। দেশটির তরুণ-তরুণীরা মোবাইল ফোন নিয়ে চিন্তা না করে ম্যান্ডেলার পরে দক্ষিণ আফ্রিকার কী হবে সেটা নিয়েই বেশি চিন্তা করে। জন্মের পর ম্যান্ডেলার নাম রাখা হয় রোহিললাহলা। খোসা ভাষায় যার অর্থ গাছের ডালপানা টানা কিংবা সমস্যা সৃষ্টিকারী বা দুষ্টু। প্রথমে স্কুলে ভর্তির পর এক শিক্ষিকা তার নাম রাখেন নেলসন। এই শিক্ষিকা কেন ব্রিটিশ সেনাপতির নামে তার নাম রাখলেন সেটা জানা যায়নি। তবে ম্যান্ডেলা সেই রণনায়ককেও ছাড়িয়ে গেছেন। ম্যান্ডেলা ছদ্মবেশ ধারণ করতে দারুণ পটু ছিলেন। বক্সিংয়ের প্রতি ম্যান্ডেলার চরম আগ্রহ থাকলেও তিনি এর সহিংসতার দিকটি পছন্দ করতেন না। তবে এর বৈজ্ঞানিক দিকটি পছন্দ করতেন। ম্যান্ডেলার প্রিয় খাবার ছিল গৃহপালিত পশুর ভুঁড়ি। কারাভোগের সময় ম্যান্ডেলা উইলিয়াম আর্নেস্ট হেনরির 'ইনভিক্টাস' কবিতাটি বন্দীদের পড়ে শোনাতেন। এর অর্থ ছিল কখনও হার না মানা। আর তাই তো তিনি হার মানেননি।
১৫ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাসস্থান প্রত্যন্ত কুনু গ্রামে সমাহিত করা হয় তাকে। তার নাম উচ্চারণের সময় বয়োজ্যেষ্ঠদেরও কণ্ঠ নিচু হয়ে এসেছিল। বিশ্বজুড়ে যার খ্যাতি ছিল সেই মাদিবাকে কেন গ্রামে যেতে হবে? কিন্তু তারপরও নিজের শেকড়ের সঙ্গে তথা শৈশবের কুনু গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেননি ম্যান্ডেলা। তার বন্ধুবান্ধবের তালিকায় সব ধরনের বৈচিত্র্যময় মানুষ ছিল।
১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। বোর্ডিং স্কুল শেষ হওয়ার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ফোর্ট হেয়ারে ভর্তি হন। সেখানে কর্তৃপক্ষের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি। ফলে বহিষ্কার করা হয় তাকে। কাজকে কখনও ছোট করে দেখেননি তিনি। জোহান্সবার্গের শহরতলীতে থাকার সময় তিনি নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। কাজ করেন আইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কেরানি হিসেবেও।
১৯৫৫ সালে এএনসির স্বাধীনতা সনদ প্রণয়নে মূল ভূমিকা রাখেন ম্যান্ডেলা। সেই সনদে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা এদেশের জনগণের। এই দেশ কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ সবার। রোবেন দ্বীপের কারাগারের প্রহরী ক্রিস্টা ব্রান্ড। ৫৩ বছর বয়সী এই শ্বেতাঙ্গ স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'ম্যান্ডেলা ছিলেন আমার কয়েদি, প্রেসিডেন্ট এবং বাবা। ম্যান্ডেলা কারাগারে বন্দী থাকার সময় অনেক শ্বেতাঙ্গ তাকে শয়তান ভাবত। অথচ এখন তাদের কাছেই তিনি ঈশ্বর।' তার পরিবারের মুখপাত্র লে. জেনারেল থেমবা টেমপ্লেটন মাতানজিমা বলেন, 'আমাদের পরিবারের স্তম্ভ সরে গেছে। কিন্তু তিনি আমাদের হূদয় ও অন্তরে সব সময় থাকবেন।'
সক্রিয় রাজনীতি থেকে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন ম্যান্ডেলা। ২০০৪ সালের জুনে জনসমক্ষে সামাজিক ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার অংশগ্রহণ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর ৪ মাস ১৭ দিন। গত বছরের ডিসেম্বরে পিত্তথলির পাথর নিয়ে তিনি প্রিটোরিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৫ দিন চিকিত্সা শেষে জোহান্সবার্গের বাসায় ফেরেন। চলতি বছরের মার্চে আবার নিউমোনিয়া নিয়ে ১০ দিন হাসপাতালে কাটান। জুনের ৮ তারিখে ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ের সামনে ম্যান্ডেলার প্রতিকৃতি উন্মোচনের মাধ্যমে শোকের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ম্যান্ডেলাকে সমাহিত করার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'ম্যান্ডেলার আদর্শ ও মূল্যবোধ অবশ্যই একটি জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যেতে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।'
ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার দেশের স্বপ্ন এঁকেছিলেন মানবতার তুলি দিয়ে। যে তুলিতে সব রঙের আধিপত্য ছিল। তাই বলে তিনি নিজের পছন্দের রঙটাকে শেষ হতে দেননি। কেবল নিজের রঙের সঙ্গে অন্য রঙের সৌহার্দ আর সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। সেই সৌহার্দ আর সম্প্রীতি তাকে বিশ্বে অধিষ্ঠিত করেছে এক অন্যরকম মানুষ হিসেবে। মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতার দেবতা।