২৪ এপ্রিল, সকাল পৌনে ৯টা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা। নয় তলা এই ভবনটি চোখের নিমেষে ভেঙে পড়ে। ঘটে যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প-কারখানা দুর্ঘটনা। শত শত মানুষের কান্না আর আহাজারিতে সারাদেশের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর খাতায় নাম লেখায় ১১শ ৩৪ জন। এদের প্রায় সবাই ওই ভবনে ইথারটেক্স লিমিটেড, নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড, ফ্যানটম অ্যাপারেলস লিমিটেড ও ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিক। আহত হয় প্রায় ৪শ জন। এদের মধ্যে প্রায় ২শ জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন। প্রায় ২৫শ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ভবন ধসের পর শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে এই মর্মান্তিক ঘটনায় দৃষ্টি নিবন্ধন হয়।
ভবন ধসের পর হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে ওই এলাকায়। পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজে নেমে পড়ে। ধ্বংসস্তূপ সরাতে হাইড্রোলিক ড্রিল মেশিন, বুলডোজার এবং ক্রেনসহ ভারি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। জীবিত একজন উদ্ধার হলেই উদ্ধারকারীদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ নেমে আসে। এক পর্যায়ে শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে কখন প্রিয়জনের লাশটি হাতে পাবে। স্বজনরা নিখোঁজদের ছবি ও ঠিকানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। জীবিত নয়; যেন লাশটি উদ্ধার করে হাতে দেওয়া হয়—এমনই আকুতি করতে থাকে প্রিয়জনরা। আর আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে সরকারি উদ্ধারকারী দলের সাথে স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় সাধারণ জনতা। তারা স্বেচ্ছাসেবী দলে নাম লিখিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ে। উদ্ধার করা লাশ রাখা হয় সাভারের অধরচন্দ্র হাইস্কুল মাঠে। সেখানে লাশের সন্ধানে প্রিয়জনরা অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ কেউ স্বজনদের পরনের কাপড়ের নমুনা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করেন। লাশ যদি চেনা না যায় অন্তত কাপড় দেখে হলেও প্রিয়জনের লাশ শনাক্ত করতে হবে। ২০ দিন ধরে চলে উদ্ধার কাজ। ২০ দিন পর উদ্ধারকাজে সমাপ্তি ঘোষণা করে উদ্ধার কাজের প্রধান সমন্বয়কারী সেনাবাহিনী। নিহতদের মধ্যে ৩২২ জনের লাশ শনাক্ত না হওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ১৫৭ লাশের পরিচয় শনাক্ত করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ন্যাশনাল ডিএনএ ফরেনসিক প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল)। পঙ্গুত্ব বরণকারী প্রায় ২শ শ্রমিকের মধ্যে কয়েকজনকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে আনার চেষ্টা করা হয়। রানা প্লাজার ৭ম তলায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন পাবনার রেহেনা। ভবন ধসে তার দুইটি পা হারাতে হয়। পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান—নিটোরের সহযোগিতার তার দুইটি কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয়। এখন তিনি নতুন দুই পায়ে ভর করে হেঁটে চলেন।
উদ্ধার কাজ চলার ১৬ দিন পর ১০ মে বিকালে অবিশ্বাস্যভাবে উদ্ধার হয় নারী শ্রমিক রেশমা। ভবন ধসের ৩৯১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এই রেশমাকে উদ্ধার নিয়ে বিশ্বে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। তিনি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার আনসার আলীর মেয়ে। গত ২ এপ্রিল তিনি রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেন। রেশমাকে উদ্ধারের পর সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২৭ দিন মেডিকেল বোর্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে চিকিত্সায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে গুলশানের পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ রেশমাকে চাকরির প্রস্তাব দেয়। তাকে ওই হোটেলে হাউসকিপিং বিভাগের পাবলিক এরিয়া অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ভবন ধসের ঘটনায় সাভার থানায় এসআই ওয়ালী আশরাফ খান বাদি হয়ে দণ্ডবিধি ৩০৪ (ক) (অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু) ধারায় ও রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল আহম্মেদ বাদি হয়ে ইমারত আইনে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করেন। অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক, গার্মেন্টস মালিক আমিনুল ইসলাম, ডেভিড মেয়র রেকো, আনিসুজ্জামান ও বজলুস সামাদকে আসামি করা হয়। ইমরাত আইনে দায়ের করা মামলায় ভবন মালিক আব্দুল খালেক, সোহেল রানা, সাভার পৌরসভার সাবেক ৩ প্রকৌশলীকে আসামি করা হয়। এই দুই মামলা পরে তদন্তের জন্য সাভার থানা থেকে সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। ২৮ এপ্রিল যশোরের বেনাপোল থেকে সোহেল রানাকে গ্রেফতার করা হয়। একদিন পর রাজধানীর মগবাজার থেকে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেককে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে বিদেশি নাগরিক ডেভিড মেয়র রেকো বাদে বাকিরা আদালতে আত্মসমর্পন করেন। এই দুই মামলায় এসব আসামিদের গ্রেফতারের পাশাপাশি সাভার পৌর মেয়র আলহাজ্ব রেফাত উল্লাহ ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলীসহ সর্বমোট ২১ জনকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এই দুই মামলার তদন্তকাজ প্রায় শেষের দিকে। তদন্তকাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
ভবন ধসে যারা মেরুদণ্ড ভেঙে, কোমর ভেঙে ও অঙ্গ হারিয়ে বিছানায় আজও শুয়ে আছেন—তাদের নিয়ে কেউই কথা বলে না। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত। এ পর্যন্ত রানা প্লাজা ধসের নিহত ও আহতদের পরিবারকে সঠিক নিয়মে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়নি। নিহতদের মধ্যে ৭শ ৭৭ জনের পরিবারকে ১ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে। আহতদের মধ্যে যাদের অঙ্গহানি ঘটেছে, তাদেরকে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া আহতদের চিকিত্সায় খরচ হয়েছে আনুমানিক তিন কোটি টাকা। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের বেশিরভাগই ছিলেন পরিবারের কাছে একমাত্র আর্থিক সম্বল। নিহত হওয়ার পর ঐসব পরিবারের এখন কেউ খোঁজ রাখছেন না।