We use cookies to tailor your experience, measure site performance and present relevant advertisements. By clicking the 'ok' button, you agree that cookies can be placed in accordance with our
Privacy Policy.
দরকষাকষি শেষ হয়নি। ধনী আর গরিবের। প্রযুক্তি আর প্রকৃতির। রক্ষা ও ভোগের। ভবিষ্যত্ নিশ্চয়তা আর বর্তমানের। বলা হচ্ছে, এভাবে চললে ভবিষ্যতে পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না। যাদের কারণে এই কথা, সেই শিল্পোন্নত বা বেশি খনিজ সম্পদ ব্যবহারকারী দেশগুলো একথা মানছে। কিন্তু ভোগ কমাতে সম্মত নয়। লক্ষ্য সকলের একই। সুন্দর পৃথিবী। একমত হলেও শুরুটা করতে চাই না কেউই। অন্যকে আগে করার তাগিদ।
এ দরকষাকষি চলছে ১৮ বছর ধরে। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক দপ্তর এই দরকষাকষির আয়োজন করে চলেছে। পৃথিবীর সব দেশের মানুষের অংশগ্রহণ এখানে। শেষ মহাযজ্ঞ হয়ে গেল কাতারের দোহায়। কাতার ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি)। নভেম্বরের ২৬ থেকে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত। বিশ্বজলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর এই আলোচনায় একপক্ষ চেয়েছে সব সময় পাশ কাটাতে। অন্যদের দাবি আদায়ের চেষ্টা। প্রত্যাশার পুরোটা পূরণ না হলেও কিছুটা এগিয়েছে এমন দাবি অনেকের। সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা নিয়ে শুরু হয়েছিল এই সম্মেলন। এক দেশের প্রয়োজন আর অন্য দেশের টিকে থাকার দাবি। পৃথিবীকে দীর্ঘদিন বাসযোগ্য রাখার প্রত্যয় নিয়ে এই দরকষাকষি। বুঝে এবং জেনেও কেউ ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য অক্ষত পৃথিবী রাখতে এগিয়ে আসছে না। শুধু প্রতিশ্রুতিতেই আটকে থাকছে।
১৮ বছর চলা আলোচনায় তিল তিল করে ফল আসছে। এবছর একটু তো পরের বছর আরো একটু। সেই তিল তিল আলোচনাতে যোগ হয়েছে দোহা। দোহায় কিয়োটো প্রটোকল, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন, ক্ষতি ও বিপর্যয় (লস এন্ড ড্যামেজ) এবং নতুন আইনগত চুক্তির বিষয়ে এগিয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর পোল্যান্ডের ওয়ারশতে যে সম্মেলন হবে সেখানে নির্দিষ্ট ফল পাওয়া যাবে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনগত চুক্তি কিয়োটো প্রটোকল। এই চুক্তির মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় আট বছর বাড়ানো হয়েছে। জানুয়ারি ১, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে আগের মতই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া ও জাপান এতে স্বাক্ষর করতে এখনো রাজি হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইজারল্যান্ডসহ ১০টি শিল্পোন্নত দেশ কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় মেয়াদের এই চুক্তি করতে রাজি হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা চলছে। দোহায় শেষ হয়েছে এই দীর্ঘ মেয়াদী সহযোগিতা কার্যক্রমের আলোচনা। দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে উন্নত দেশগুলো। তবে পরিমাণ ঠিক করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপানের আপত্তি সত্ত্বেও দীর্ঘ পাঁচ বছর দরকষাকষির পর এ আলোচনার সমাপ্তি হলো। এ সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায়ই মূলত জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অভিযোজন, প্রশমন, অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে। অন্যদিকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ দেয়ার বিষয়ে আগামী বছর পোল্যান্ডের ওয়ারশতে জলবায়ু সম্মেলনে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
নতুন আইনগত চুক্তি ডারবান প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে তিন বছর মেয়াদী একটি 'কর্মপরিকল্পনা' চূড়ান্ত করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদী অর্থায়নের বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে ২০২০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে জলবায়ু সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে এতে স্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি ও বিপর্যয় পুষিয়ে নিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দের জন্য ওয়ারশতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচি নিতে সম্মত হয়েছে উন্নত বিশ্ব। তবে এই ক্ষতিপূরণ সহসা মিলবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের ফেলো ড. বিরার্ট মিরটজ। তিনি এই লেখককে বলেন, ক্ষতি ও বিপর্যয়ের যে বিষয়টি বলা হচ্ছে তা আপেক্ষিক। যে যার মতের উপর নির্ভর করে এবিষয়টি উপস্থাপন করছে। যার কারণে এবিষয়ে ফলাফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ। নতুন আইনগত চুক্তি করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছে সব দেশ। ২০১৫ সালের মধ্যে সকল দেশের অংশগ্রহণে আইনীভাবে বাধ্যতামূলক একটি নতুন চুক্তি করার ইচ্ছা আবারও জানিয়েছে সম্মেলনে অংশ নেয়া সব দেশ। ২০২০ সালের পর এই চুক্তি কিয়োটো প্রটোকলকে প্রতিস্থাপন করা হবে। এবার সম্মেলনে অর্থের হিসাবের গড়মিলটি ছিল বেশ আলোচিত। উন্নত দেশগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে ৩২ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলো বলেছে, তারা পেয়েছে মাত্র চার বিলিয়ন ডলার। বিষয়টি অমীমাংসিতভাবে আলোচনার টেবিলেই রয়ে গেছে।
দরকষাকষির আলোচনায় অংশ নেয়া প্রতিনিধিরা বিভিন্নভাবে এই সম্মেলনকে মূল্যায়ন করেছেন। জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া চায়না প্রতিনিধি দলের প্রধান ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্ড রিফর্ম মন্ত্রী সিনহ জুনহুয়া এই লেখককে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, এই সম্মেলনে যা হয়েছে তাতে সামগ্রিক দিক থেকে আমরা সন্তুষ্ট নই। আশা ছিল আরো অনেক বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাওয়া যাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়ন, কিয়োটো প্রটোকল, ক্ষয় ও দুর্যোগসহ কয়েকটি বিষয়ে ফল পাওয়া গেছে।
এবছর দোহার ইতিহাসে প্রথম রাস্তায় মিছিল বা প্রতিবাদ হয়। পরিবেশবাদীরা বের করে এই মিছিল। কাতারের স্বাধীনতার এই ৪০ বছরে কোনদিন কোন রাস্তায় কোন বিষয়ে মিছিল বা প্রতিবাদ সমাবেশ হয়নি। পৃথিবী রক্ষার পক্ষের মানুষেরা অংশ নেয় মিছিলে। দোহার রাস্তায় নানা পোস্টার আর নানান সাজে নেমে এসেছিল তারা। পৃথিবী রক্ষায় বিশ্বনেতাদের নজর কাড়তে ব্যস্ত ছিল প্রতিবাদকারীরা। কাতারের রাজধানী দোহা বিশ্ব নেতাদের পদচারণায় যখন মুখর, তখন তাদের কাছে একটাই দাবি— যেন জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষায় রাজনৈতিক ঐক্যে আসেন সকলে। যেন কার্বন নির্গমন কমাতে অন্তত প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান সকলে। এছাড়া সম্মেলন কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে বিশ্বনেতারা দেখেছেন প্রতিবাদ ও সচেতন করতে নানা ব্যতিক্রমী আয়োজন। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের কাছে সমঝোতায় আসার আহবান জানিয়েছে। সবুজ গড়ো বিশ্ব বাঁচাও, কার্বন নিগর্মন কমাও, বাসযোগ্য বিশ্বগড় ইত্যাদি শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড শরীরের বিভিন্ন অংশে জড়িয়ে বিশ্বজলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন অনেকে। হঠাত্ই সম্মেলন চত্বরের মধ্যে কোথাও মানববন্ধন কিম্বা প্রতীকী অন্য কোন আয়োজন। এবার সম্মেলনের অন্যতম একটি দিক ছিল কাগজের ব্যবহার। সম্মেলনে সচেতনভাবেই কাগজের ব্যবহার করা হয়নি। ইন্টারনেট এবং পেন ড্রাইভের মাধ্যমে তথ্য দেয়া-নেয়া করা হয়েছে। এতে ২৫৭টি গাছ রক্ষা পেয়েছে আর কাগজ বেঁচেছে দুই লাখ ৬৮ হাজার কাগজের সিট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তবে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। এখন এই ভয়াবহতা কিভাবে ঠেকানো হবে তারই অপেক্ষা।