আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল থাকলেও নতুন বছরের শুরুতেই বাড়নো হলো জ্বালানি তেলের দাম। এনিয়ে বর্তমান সরকারের সময়ে সাতবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। শুধু ২০১১ সালেই চারবার দাম বাড়ানো হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক হয়নি, নির্বাচনী বছরে বাজেটে চাপ কমাতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই রবিবার হরতাল ডেকেছে বিরোধীদল। লাগাতার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পেট্রোলপাম্প মালিকরা। অন্যদিকে গতকাল সিলেটে এক অনুষ্ঠানে দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধীদলের ডাকা হরতাল সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, 'এটি একটি উন্মাদের সিদ্ধান্ত'।
ইতিপূর্বে সরকারিভাবে একই সাথে জ্বালানির দাম ও পরিবহনের ভাড়া সমন্বয়ের কথা বললেও তা হয়নি। ফলে গতকাল থেকেই দেশ জুড়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে যাত্রী ও পরিবহন কর্মীদের মধ্যে ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পেটে াল পাম্প বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সাথে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের বিক্রয়মূল্যের ব্যবধানের কারণে ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রয়ে লিটার প্রতি যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৭৭ টাকা ও ১৯ দশমিক ১৫ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুযায়ী গতকাল অপরিশোধিত তেলের মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ৯২ দশমিক ৮৫ ডলার। গত এক বছর যাবত্ এ দাম ব্যারেল প্রতি ১শ' থেকে ১২০ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ মূল্য দীর্ঘদিন একশ' ডলারের নিচেই ছিল। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী এক বছর ব্যারেল প্রতি দাম গড়ে ১০৭ ডলার থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক হয়নি বলে উল্লেখ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বাংলাদেশে আসন্ন গরমের সময় উচ্চমূল্যের ভাড়ায় আনা বিদ্যুত্ কেন্দ্র চালাতে যে বাড়তি তেলের অর্থ লাগবে তা জোগাড় করতেই দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া অন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে দেশের ভর্তুকির উপর চাপ কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চাপ রয়েছে সরকারের উপর। অন্যদিকে ভাড়াভিত্তিক বা কুইক রেন্টালের চাপ রয়েছে। এ দুই মিলিয়ে নির্বাচনী বছরে বাজেটে চাপ কমাতে দাম বৃদ্ধির অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া:
বর্তমান পরিস্থিতিতে দাম বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্ন করা হলে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে পরিবহনসহ সকল খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ভর্তুকি কমাতে চাপ রয়েছে সরকারের উপর। এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও হতো। অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে সরকার ভর্তুকির চাপ কমাতে পারতো।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির হারও সঠিক হয়নি। তাছাড়া এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিনিয়োগের যে অবস্থা তাতে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেছেন, চলতি বছর নির্বাচনী বছর। আর এ বছরে সরকার বাজেটে চাপ কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসলেও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে এ হার বেড়ে যাবে। বিশেষ করে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে অনেক বেড়ে যাবে। ধান উত্পাদনে কৃষকরা চলতি বছর ভালো দাম পায়নি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকদের ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। ফলে কৃষকরা উত্পাদনে নিরুত্সাহিত হবে। ফলে কৃষি পণ্যের মূল্য আরো বেড়ে যেতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ইত্তেফাককে বলেন, এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী হয়নি। ভাড়ায় আনা বিদ্যুত্ কেন্দ্র চালাতে সরকারের ভর্তুকি বেড়েছে। অন্যদিকে এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য খেসারত জনগণের উপর চাপানো হচ্ছে।
পাম্প মালিকদের জরুরি বৈঠক:
কমিশন বৃদ্ধি না করে দাম বাড়ানোর ফলে জরুরি বৈঠক করেছেন পেট্রোল পাম্প মালিকরা। এ পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক ইত্তেফাককে বলেন, সরকার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানের সাথে সাথে পাম্প মালিকদের কমিশন বৃদ্ধি করার জন্য সরকার অঙ্গিকার করলেও তা রক্ষা করেনি। ২০১১ সালের মে মাসে সরকারের সাথে এক চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সাথে সাথে কমিশন বাড়ানোর চুক্তি করলেও সরকার তা রক্ষা করেনি। বর্তমানে ডিজেলে আড়াই শতাংশ এবং অকটেন ও পেট্রোলে শোয়া তিন শতাংশ কমিশন পান পাম্প মালিকরা। মালিক পক্ষের দাবি এ হার যথাক্রমে সাড়ে তিন ও চার শতাংশ। কমিশন বৃদ্ধি করা না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হবে বলে গতকাল সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে ঘোষণা আসবে বলে জানান তিনি।
বিপিসির ব্যাখ্যা:
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দাবি অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বাজারে বর্তমান বিক্রয়মূল্য অব্যাহত রাখলে এবং আন্তর্জাতিক বাজার দর অপরিবর্তিত থাকলে এ অর্থবছরে বিপিসি'র প্রায় ৮ হাজার ৫শ' কোটি টাকা আর্থিক ঘাটতি হতো। ৩ জানুয়ারির মধ্য রাত থেকে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিলিটার ডিজেল ও কেরোসিন এর বিক্রয় মূল্য ৭ টাকা বৃদ্ধি করে যথাক্রমে ৬৮ টাকা ও ৬৮ টাকা এবং অকটেন ও পেট্রোল এর বিক্রয় মূল্য ৫ টাকা বৃদ্ধি করে যথাক্রমে ৯৯ টাকা ও ৯৬ টাকায় পুনঃনির্ধারণ করেছে। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির পরও ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রয়ে সরকারকে লিটার প্রতি যথাক্রমে ১১ দশমিক ৭৭ টাকা ও ১২ দশমিক ১৫ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি। এর আগে সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেন এর বিক্রয়মূল্য যথাক্রমে ৬১ টাকা, ৬১ টাকা, ৯১ টাকা ও ৯৪ টাকায় পুনঃনির্ধারণ করা হয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আর্থিক শৃংখলা ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সরকারের অন্যান্য আবশ্যকীয় সামাজিক নিরাপত্তাজনিত ব্যয় নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে।
সিলেটে অনেক পাম্প বন্ধ ছিল
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরই সিলেট বিভাগের শতাধিক পেট্রোল পামপ বৃহসপতিবার রাতে বন্ধ রাখা হয়। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ৪৯টি, বাকিগুলো হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। রাত সাড়ে ১০টার পর থেকে এসব পামপ শুক্রবার ভোর থেকে বন্ধ ছিল। সিলেট পেট্রোলিয়াম ডিলার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি জুবায়ের আহমদ জানান, হঠাত্ যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এ জন্য পাম্প বন্ধ রাখেন মালিকরা। পামপ বন্ধ করে দেয়ায় শুক্রবার সকাল থেকে সিলেটে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন চালকরা।