বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য নতুন কিছু নয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ সবসময় যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন যে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখোমুখি এসে পৌঁছেছে। এই মুহূর্তে তারা ক্ষমতায় না এলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই প্রচার আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এর বিপরীতটাও আছে। সরকার এবং তাদের নব্য ও নিয়মিত অনুসারীরা সবকিছুই ফকফকা দেখেন। অর্থনীতির ব্যাপক প্রসার দেখেন। তারা ক্ষমতায় না থাকলে দেশ রসাতলে যাবে বলে ভাবেন। এটিও বাংলাদেশে প্রথায় পরিণত হয়েছে। আবার একটি গ্রুপ আছে যারা কখনোই কোনো কিছুতেই অগ্রগতি দেখতে পান না। তারা সব সময় বর্তমানকে "মন্দ" হিসেবে দেখেন। আর এ মন্দটা প্রমাণ করার জন্য তারা তাদের শৈশবে চালের মণ আট আনা ছিল সেই উদাহরণ টানতেও পিছপা হন না। তারা সাহসিকতার সাথে জনগণকে বিভ্রান্ত ও দিকভ্রান্ত করেন। এই তিন গ্রুপই তথ্য নিজের মতো করে পর্যালোচনা করেন। অনেক সময় বিকৃত করেন।
অর্থনীতির গতি প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই একে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন দেশ বহির্মুখী অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে থাকে। প্রথমে শিল্পোন্নত দেশগুলো এ পথ দেখায় তাদের শিল্পপণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে। এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে গতিশীলতা বাড়ে। সব দেশই কম-বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলো যাদেরকে ১৯৭০'র দশক থেকে স্বল্পোন্নত বিশ্ব বা এলডিসি হিসেবে অভিহিত করা হয় তাদের উন্নতির কোনো সম্ভাবনা তৈরি করা যায়নি। অগত্যা ঠিক হয় তাদের জন্য বিশ্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ব্যবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। নীতি প্রতিপালনে বিশেষ ছাড় দেয়া হবে। যাতে তারা দ্রুত এগিয়ে আসতে পারে। এসব নীতি-পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশই ঘটে ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তার পরের কয়েক বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মন্দার মধ্যে পড়েছিল। তবে এক-দুই বছরের মধ্যেই সবগুলো দেশ আবার প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে। বিশ্ব এগিয়ে যায়। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে ২০০৭ পর্যস্ত। ২০০১ সালের পর থেকে বিশ্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে ডব্লিউটিও উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি। কৃষিপণ্য উত্পাদন ও রপ্তানিতে ভর্তুকি, শিল্প ও কৃষিপণ্যের আমদানি শুল্ক হরাস ইত্যাদি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে ডব্লিউটিও'র "দোহা রাউন্ড" অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়। আর্থিক সমস্যা সংকটে রূপ নেয়। এ সংকট মন্দা ডেকে আনে। যা এখনো ইউরোজোনের কোনো কোনো দেশে বেশ দাপটের সাথেই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিশ্ব অর্থনীতি ২০১৩ সালে কেমন যাবে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বাভাস দিয়েছে। এসব ভবিষ্যদ্বাণী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইউরোজোনের আর্থিক সংকট পরিস্থিতির আর অবনতি না হলেও উন্নতি হওয়ার তেমন লক্ষণ নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১২ সালের মতো ঋণাত্মক না হলেও বড়জোর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে "ফিসক্যাল ক্লিফ" নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। বাজেট ঘাটতি মেটানোর কৌশল নিয়ে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেট ও বিরোধী রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যরা প্রায় দুই বছরে ধরে দুই মেরুতে অবস্থান করছিলেন। একেবারে শেষ সময় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হয়। তাও আগামী দুই মাসের জন্য উচ্চবিত্তের ওপর কর বাড়িয়ে এবং সরকারি ব্যয় কিছুটা কমিয়ে বিশাল বাজেট ঘাটতি হরাসে নতুন আইন হচ্ছে। দুই মাস পরে দীর্ঘমেয়াদী আইন প্রণীত হবে। এর ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় বিশ্ব অর্থনীতিতেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ভোক্তা চাহিদা হরাস ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিশ্ব ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। ২০১২ সালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রবৃদ্ধিও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ২০১২ সালের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়ার কম হারের জন্য তারা ভারতের প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হওয়াকে দায়ী করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের প্রবৃদ্ধি গত বছর কিছুটা মন্থর হলেও ২০১৩ সালে তা আবার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। জাপানে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশটির প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে উন্নীত হবে বলে বিশ্লেষকরা আশা করছেন। ব্রাজিল ও মেক্সিকোর অর্থনীতিও ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারবে। সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতি গত চার বছরের চেয়ে ভাল যাবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উচ্চাশা পোষণ করেছে। সবাই বাংলাদেশের অর্থনীতিরও অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বাঙ্গনে এত প্রশংসা ও এত আশাবাদ আর কখনো হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাত্ক্ষণিক কোনো লাভ হয়নি। তবে দেশীয় একশ্রেণীর অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে এখন অর্থনীতি বাদ দিয়ে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। এটি সরকারের জন্য স্বস্তির হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ অর্থনীতির ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতি বড় করে দেখানোর ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অধিক সতর্কতা অবলম্বন করে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। যা প্রকারান্তরে সার্বিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদগণ বাংলাদেশের অর্থনীতির ভাল অবস্থার জন্য যে কয়েকটি পদক্ষেপকে অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে সফল অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ অন্যতম। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবে।
বাংলাদেশ বিগত চার বছর ধরেই অর্থনীতিতে ভাল করেছে। রপ্তানি আয় ১৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে বিশ্ব রপ্তানিতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাংলাদেশ প্রায় ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমদানিতে প্রায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই আমদানির প্রায় ৫৮ শতাংশ ছিল ক্যাপিটাল মেশিনারী ও শিল্প কাঁচামাল। রপ্তানি আয়ে একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মেঘ কেটে যাওয়ায় ধরে নেয়া যায় যে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এ বছর বাড়বে। ইউরোপের অর্থনীতি ২০১২ এর তুলনায় ভাল হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়ায় ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আশার কথা, ইউরোপে মন্দা ও চাহিদা কমে গেলেও বাংলাদেশের নিট ও ওভেন পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১২ সালে নিট পোশাকে প্রায় ২ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাই শ্রমঘন এ খাতটিতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আসবে। জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রাপ্তিতেও বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রায় ৬ লাখ জনশক্তি বিদেশে গেছে। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার বাজারটি উন্মুক্ত হয়েছে। কুয়েত ও কাতারের বাজারেও বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তাই ২০১৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স দুটোতেই ভাল প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধরে নেয়া যায়।
বাংলাদেশ এখন "ডেমোগ্রাফিক ডিভিভেন্ট" বা জনসংখ্যার লভ্যাংশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এরাই পূর্ণ কর্মক্ষম গ্রুপ। আগামী তিন থেকে চার দশক বাংলাদেশ এ স্তরে অবস্থান করবে। এ বিশাল কর্মশক্তির পুরোটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা সম্ভব হলে কোনো বাধাই বাংলাদেশের অগ্রগতিকে স্তিমিত করতে পারবে না। এজন্য শ্রমঘন খাতগুলোকে চাঙ্গা করতে হবে। এর সাথে সাথে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ মানব উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে গড় শ্রম উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর বর্তমান উদ্যোগগুলোকে আরো গতিশীল করলে প্রবৃদ্ধি আরো দ্রুত বাড়বে।
বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়া উচিত তা পাচ্ছে না। যদিও সরকার গত বছরে ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ আসতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। গ্যাস, বিদ্যুত্, যোগাযোগ অবকাঠামো আরেকটু স্থিতিশীল হলে তখন বিনিয়োগ বেশি আসবে। সরকার পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ব্লক এওয়ার্ড করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ উদ্যোগটি সফল হলে ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে। সরকার ৩৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫২টি বিদ্যুত্ কেন্দ নির্মাণ করেছে। কিন্তু এর অধিকাংশই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র এবং তরল জ্বালানি নির্ভর। তেলের আন্তর্জাতিক দাম ২০১২ সালে ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলারের বেশি ছিল। এবারও তাই থাকবে। তাই সরকারের ইচ্ছা থাকলেও নবনির্মিত সবগুলো বিদ্যুত্ কেন্দে র পুরো চাহিদা অনুযায়ী তরল জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবে না। এ বছর হরিপুর ও মেঘনাঘাটসহ কয়েকটি গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ উত্পাদনে আসবে। এর ফলে আরো প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ পাওয়ার সুযোগ হবে। সেই অনুযায়ী গ্যাসের উত্পাদন বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই বিনিয়োগকারীদেরকে পর্যাপ্ত সরবরাহ করার মতো বিদ্যুত্ ২০১৩ সালেও পাওয়া যাবে না। তবে সরকার বিদ্যুতের গৃহস্থালী, সেচ, বাণিজ্যিক চাহিদা ভালভাবেই মেটাতে পারবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আছে। তাই জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কিছুটা কমিয়ে দিয়ে আমদানি বেশি করলে আর্থিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে না।
গত চার বছর ধরে আবহাওয়া কৃষি অনুকূল ছিল। সরকার কৃষকদেরকে ভর্তুকি, ঋণসহ বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে কৃষকদের উত্সাহ ধরে রেখেছে এবং অনুকূল পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। তাই দেশ শুধু চাল উত্পাদনেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে তা নয়, শাক-সবজি, মসলা, ফল ইত্যাদি উত্পাদনও বেড়েছে। কৃষিজাত পণ্য উত্পাদন বেড়েছে। কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার গ্রাম উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এসব কাজে অপচয় বেশি হয়। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু একটা লাভ হয়। এই অর্থের একটা বড় অংশ গ্রামে ব্যয় হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা বাড়ে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্তরা এর ফল ভোগ করে। ধনী-গরীব বৈষম্য হরাসে এটি প্রণোদনা যোগায়। আর্থিক খাতে গত বছর শেয়ার বাজারের নিম্নগতি, হলমার্ক ও ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারীসহ বেশ কয়েকটি বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এগুলো অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে নেতিবাচক। তবে বাংলাদেশে ঋণখেলাপী, অধিক মুনাফা দেয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া, শেয়ার বাজারে কারসাজি এগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এখন মিডিয়া বেশ তত্পর এবং জনগণ অনেক সচেতন। তাই কোনো দুর্নীতি, কারসাজি, জালিয়াতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রই গোপন থাকে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটি একটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। নিয়ন্ত্রণ ভালভাবে করলে এবং শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এসব দুর্নীতি একসময় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে। ২০১২ সালের এ ঘটনাগুলো থেকে সরকার, নীতি প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনগণের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সকলকেই আরো তত্পর হতে হবে। সচেতন হতে হবে। সক্রিয় হতে হবে। যাতে সমাজ থেকে সব ধরনের অনিয়ম দূর করা যায়। তাহলে দারিদ্র্য হরাসের হার বর্তমানে বছরে আড়াই শতাংশের চেয়ে আরো বেশি হরাস পাবে। দারিদ্র্য দ্রুত কমাতে পারলে জাতীয় কর্মশীলতাও বাড়বে।
অনেকেই ২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচনের বছর বিধায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা ভাবছেন এবং তা অর্থনীতির প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। ১৯৮০ বা ১৯৯০'র দশকে এটি সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন রাজনৈতিক দলগুলোরও বোধোদয় হয়েছে যে মানুষকে অচল, ঘরকোণো করে দেয়ার মতো কোনো কর্মসূচি জনগণ আর ভাল চোখে দেখছে না। মানুষ সরকারের কাছে এখন আর অর্থ চায় না। শুধু সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। যাতে তারা নিরাপদে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আগে সবাই সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো। এখন সেই অবস্থা নেই। কেউ বসে থাকতে চায় না। নিজের সামর্থ্য , মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে জীবিকার পথ বেছে নিচ্ছে। তাই নির্বাচনের বছর হলেও দেশের উত্পাদনশীলতা কমবে না। বরং নির্বাচনী কাজে বাড়তি জনশক্তি ব্যবহূত হবে। এর ফলে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ছে। অর্থনীতি তা-ই বলে। কর্মের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ হওয়ার স্বার্থেই সকলকে তা করতে হবে।