
সেই মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্নে ভুল করেছিলেন আদম নিষিদ্ধ বৃক্ষের কাছে গিয়ে। অতঃপর ভীত ও লজ্জিত আদমের প্রতি শ্রষ্টার অভয় ছিল "কুলনাহবিতু মিনহা জামিআন ফাইম্মা ইয়াতিয়ান্নাকুম মিনিহুদা ফাশন তাবিআ' হুদায়া ফাল খওফুন আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহযানুন" (সুরা বাকারা) অর্থাত্ ভুল যখন করেই ফেলেছ তখন তোমরা উভয়েই অবতরণ কর এই জান্নাত থেকে, যদি তোমরা তথায় (দুনিয়াতে) আমার নির্দেশনা অনুসরণ কর। তবে তোমাদের দুঃশ্চিন্তা নেই, নেই কোন ভয়। সেই থেকে শ্রষ্টা তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুগে যুগে যুগের প্রেক্ষিতানুযায়ী হেদায়েত বা পথনির্দেশিকা দিয়ে আসছেন। যার সর্বশেষ পথনির্দেশক ও সংস্কারক হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সংস্কার ও দাওয়াতী জীবন পরবর্তী তার অনুসারীদের লেখা-লেখনী খানকাহী সংস্কার শিক্ষা ও দীক্ষার ধারাবাহিকতা নানাভাবে চলছেই। রাসূল সা. এর সাহাবাগণ সারা বিশ্বে ছড়ায়ে পড়েছিলেন এবং দাওয়াত ও দীনি দীক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতার ফলেই আজ আমরা মুসলমান। বৃটিশ পূর্ব ভারতের ইসলাম প্রচার ও সংস্কারের একটি ঐতিহ্যগত দিকছিল মাদ্রাসা শিক্ষা যা তত্কালীন মানুষের ঈমানী চেতনা। সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখত বৃটিশ ভারতে ইসলামী শিক্ষা ও বৃটিশ-ভারতীয় সংস্কার, কোথাও চলতো যুগপত্ ভাবে কোথাও বা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যেতো। এক পর্যায়ে বৃটিশ বিরোধীতায় মাদ্রাসা শিক্ষা মাদ্রাসা কেন্দ্রিক এবং কেবল মাত্র প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। যার ফলে ঈমান আক্বিদার তা'লিম তাহযীব ও তমুদ্দন বিশেষ শ্রেণী পর্যন্ত আগ্রহী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বৃটিশ ভারতীয় যুগের শেষ প্রান্তে এসে ১৯২৭ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রঃ যিনি কান্দাতে উত্তর প্রদেশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং দিল্লিস্থ পশ্চিম নেজামুদ্দিনের বাঙলে মসজিদে সাধারণ অসচেতন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে কাতর কণ্ঠে অতিসাধারণ ভাষায় ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান জানাতেন। তিনি যেমন ঠিক করে দিতের মুখের সালাম ও কালাম, শুধরে দিতেন নামায তেমনই শুধরে দিতেন সামাজিক ও পারিবারিক জীবন। একাজ তিনি নিজেও করতেন এবং দলবদ্ধভাবে একটি দল বা জামাত গঠন করে দূরবর্তী কখনও বা কাছের কোন মহল্লায়ও পাঠাতেন। তত্কালীন বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামগণ এই সাধারণ মানুষকে ধর্মের প্রতি আহ্বান ও সংস্কারের প্রতি কেউ কেউ গভীর শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। কেউবা এ পদ্ধতিকেও বিদআ'ত বলে সমালোচনাও করতেন। হযরত মাওলানা মঞ্জুর নোমানী রঃ তার "তাবলিগ জামাতের সম্প্রসারিত দৃষ্টি কোন"। "জামাআ'তে তাবলিগ উসআতি নাযারিয়াত" পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন যে, একদা তত্কালীন আলেমগণ বললেন-মাওলানা তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিই কুয়া বা পুকুরে যায়। পুকুর বা কুয়া কখনও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে আসে না। আপনি যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছেন তাতে কি কিছুটা ইলম বা দাওয়াত সস্তা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছে না।
প্রতি উত্তরে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রঃ বলেছিলেন, ভাই আমি ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আমার দাওয়াতী কার্যক্রমকে কুয়া বা পুকুর ভাবি না। বরং আকাশের বর্ষণমুখর মেঘ ভাবতে পছন্দ করি। যে কিনা বর্ষণকালে ভাবে না কোনটা গরীব এবং কোনটা আমীরের ক্ষেত, কোনটা সাধারণ আর কোনটা অসাধারণ। নবুয়াত পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের দীন শিক্ষা ও বিস্তার তা হলে কিভাবে হবে? আমি ইসলামের কল্যাণী শিক্ষা নামায ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের পবিত্র ও প্রাথমিক পদ্ধতিকে ধনী-গরীব, সাধারণ-অসাধারণ, কাছে-দূরে এমনকি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। কেননা দীনি দাওয়াত মানবের প্রতি করুণা নয় বরং সৃষ্টি লগ্ন থেকেই অধিকার।
প্রশস্ত ও দরদী হূদয়ের এই মহান সাধক ও সংস্কারক। চলে গেছেন দুনিয়া ছেড়ে রয়ে গেছে তার অভিনব অরাজনৈতিক দাওয়াত ও দীন শিক্ষার এই পদ্ধতি এবং ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, আরব, এশিয়া-আশিয়ানে বিশ্বময় সর্বত্র। সার্বজনিন এই তাবলিগের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশের টংগীর তুরাগতীরে। ইসলামীমহাশান্তি সম্মেলনের ক্ষেত্র তুরাগতীরের নামও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
তাবলিগের কল্যাণে টংগী কেবল শিল্প নগরী নয়, আজ হেদায়েতী সম্মেলনের বিশ্বনগরও বটে।
(লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক, আলেমেদীন ও খতীব মসজিদূত তাকওয়া, ধানমন্ডি)