দেশে হরতাল বিরোধী আইন প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা চলিতেছে। ২০১০ সালের ২২ জুলাই জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় 'জনস্বার্থ বিল-২০১০'। বিলে হরতালের কথা উল্লেখ না থাকিলেও রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণই ইহার মূলগত উদ্দেশ্য। এই বিলে প্রত্যেক জেলায় জনস্বার্থ সংরক্ষণ আদালত গঠনের প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই আদালত নাগরিকদের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টির অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ বত্সরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করিতে পারিবেন। বিলে এমনও বিধান রাখা হইয়াছে যে, কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির কারণে জনগণের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হইলে সেই দলের প্রধানসহ সর্বোচ্চ কমিটির বিরুদ্ধে মামলা করা যাইবে। বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়া পরামর্শ করিবে। কমিটির ১২তম সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, বিলটি উত্থাপন করেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি-জাপার সাংসদ মুজিবুল হক। প্রস্তাবিত আইনটি কতখানি যৌক্তিক কী অযৌক্তিক তাহা লইয়া তর্কের অবকাশ রহিয়াছে নিশ্চয়ই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইহার ভালোমন্দ সকল দিকই বাহির হইয়া আসিবে বলিয়া আশা করা যায়। কাজেই বিষয়টি লইয়া এক্ষণে মন্তব্য না করাই বাঞ্ছনীয়। তাহা হইলেও হরতাল প্রসঙ্গটি আলোচনার দাবি রাখে বৈকি।
সত্য বটে, হরতাল ধর্মঘট গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। তবে ইহাও অসত্য নয় যে, হরতাল বা বন্ধ্, ধরনা, অবরোধ, ঘেরাও, দেয়াল লিখন ইত্যাদি উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহজাত অনুষঙ্গ নয়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কাহারও ওপর কোনোভাবেই বলপ্রয়োগ কিংবা ভীতি প্রদর্শনের কোনোই সুযোগ নাই। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে গণতন্ত্র আপোষহীন। একজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া অপরের অধিকার বা স্বাধীনতা খর্ব করা যাইবে না। ইহা গণতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি। এইচ. জি ওয়েলসের উদ্দেশে বার্নাড শ বলিয়াছিলেন, দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে তোমার ছড়ি ঘুরাইবার অধিকার রহিয়াছে, তবে তাহা আমার নাকের ডগা পর্যন্ত। গণতান্ত্রিক অধিকারের সীমারেখা বুঝাইতে বার্নাড শ-এর এই অসাধারণ উক্তিটি অহরহই উচ্চারিত হইয়া থাকে। ইহার মানে যে কেহ ছড়ি ঘুরাইতে পারেন, কিন্তু তাহাতে যদি কাহারও নাসিকা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে অধিকারের সীমানা লংঘিত হইবে। সীমা লংঘন নাগরিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের বিপরীত। কিন্তু বামপন্থি রাজনীতির ধারক-বাহকগণ অপরের নাগরিক অধিকারের পরোয়া করে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দেশে-বিদেশে বামপন্থিরা সাধারণ ধর্মঘট, বন্ধ্ বা হরতালকে বরাবরই নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে তথাকথিত বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করিবার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করিয়া আসিয়াছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সাধারণ ধর্মঘট বলিতে কলে-কারখানা হইতে শ্রমিকদের রাজপথে বাহির করিয়া আনা বুঝান হয়। ব্রিটেনের কলে-কারখানায় অতীতে সাধারণ ধর্মঘট হইয়াছে বহুবার। মার্কসীয় চিন্তাধারায় শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করা হইয়াছে এবং স্ট্রাইক করা হইয়াছে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে মহাত্মা গান্ধী অহিংস হরতালের ডাক দিয়াছেন একাধিকবার। কিন্তু তাহাও শেষ পর্যন্ত অহিংস থাকে নাই। তাহার পিছনেও ছিল বামপন্থি প্ররোচনা।
আজকের বাংলাদেশে প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের কথা বলিলেও গণতান্ত্রিক ঔদার্য তাহারা যেনবা বিস্মৃত হইয়াছে। উভয়ই বাম-কম্যুনিস্ট সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। উদার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে বাম ভাইরাস ঢুকিয়া পড়িয়াছে। সেইজন্যই হরতালের কারণ ঘটে, হরতাল হয়। উপেক্ষিত হয় অন্যের অধিকার। ভাইরাস ঢুকিয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিকতা লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়াছে। চাপাতি ও চাপাইয়া দেওয়া রাজনীতি যেন আমাদের ললাটলিখন হইয়া গিয়াছে।