
শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলনের ধারণা আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলিত নয়। লক্ষ্যাপারের এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটি প্রকৃত সংগীত সম্মেলনের রূপ ফুটে উঠল। 'শেকড়ে-শিক্ষায়-মননে-সংগ্রামে চিরবাঙালি বিশ্বশিল্পী রবি শংকর'—এই উত্সর্গ উচ্চারণে অনুষ্ঠিত হলো লক্ষ্যাপার আয়োজিত '৪র্থ বার্ষিক শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মিলন'। সম্প্রতি দুই দিনব্যাপী এই সংগীত সম্মেলনে প্রাঙ্গণ নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কনভেনশন সেন্টার মুখরিত হয়ে উঠেছিল দেশ-বিদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী, শিক্ষার্থী এবং শ্রোতার সমাগমে। স্বাগত ভাষণে সম্মেলনের প্রধান উপদেষ্টা কাসেম জামাল লক্ষ্যাপারের সকল উদ্যোগের পেছনে একটি আন্দোলনের চেতনা কাজ করছে উল্লেখ করে বলেন, 'আমরা শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার প্রসারে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।' জেলা খেলাঘর সভাপতি রথীন চক্রবর্তী নারায়ণগঞ্জের সকল সংস্কৃতিকর্মীর পক্ষ থেকে এই সম্মেলনকে স্বাগত জানান এবং এর সার্থকতা কামনা করেন। উদ্বোধক ওস্তাদ রবিউল হোসেন বলেন, 'শাস্ত্রীয় সংগীতের মঞ্চ থেকে আজ দেশবাসীর প্রতি এক আশার বাণী প্রচারিত হচ্ছে।' আলোচনা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরপরই অনুষ্ঠিত হলো একের পর এক ব্যতিক্রমধর্মী সব আয়োজন। প্রথমেই 'সংগীত শিক্ষার সেকাল-একাল' বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক। এতে অংশগ্রহণ করেন দুই বাংলার শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পী, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীবৃন্দ। দ্বিতীয় পর্বে উপস্থাপিত হয় 'উপমহাদেশীয় তালবাদ্যের ভাববৈচিত্র্য' নিয়ে প্রায়োগিক আলোচনা। বিপ্লব ভট্টাচার্য (তবলা), শুষেণ রায় (পাখোয়াজ), মো. নজরুল ইসলাম (ঢোল), বিধান চন্দ্র সিংহ (মণিপুরী মৃদঙ্গ) এবং রণজিত্ কর্মকার (হাতবায়া) নিজ নিজ যন্ত্রের উত্ভব ও বিকাশের আলোচনা ও বাদনশৈলী প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। মধ্যাহ্নভোজ পর্বের পর শুরু হয় স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার দুই বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকারী মোট ছয়জনকে পুরস্কার ও সনদ প্রদানের পাশাপাশি 'হারাধন-সুখেন শাস্ত্রীয় সংগীত প্রণোদনা বৃত্তি'র আওতায় বার্ষিক ৬০০০ টাকার বৃত্তি প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। সান্ধ্য অধিবেশন শুরু হয় 'ডেমন্সট্রেশন লেকচার' দিয়ে। এই পর্যায়ে ড. রেজওয়ান আলী 'ধ্রুপদ-খেয়াল আঙ্গিকে রাগরূপায়ন' নিয়ে গানে-কথায়-প্রশ্নোত্তরে প্রাণবন্ত করে তোলেন মিলনায়তন। সেদিনের শেষ পর্বে ছিল বিপ্লব ভট্টাচর্যের একক তবলা বাদন এবং ঋতুপর্ণা চক্রবর্তীর কেদার ও মালকোষ রাগে ধ্রুপদ গান পরিবেশনা। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান ছিল তিন পর্বে বিভক্ত। উত্সর্গ পর্বে সদ্যপ্রয়াত রবি শংকর স্মরণে উত্সর্গপত্র পাঠ এবং একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর 'গুণীজন সম্মাননা' পর্বে 'জীবনব্যাপী সাধন-রূপায়ন-শিক্ষাদানের ব্রতে অবিচল' থাকার জন্য 'লক্ষ্যাপার আজীবন সম্মাননা' প্রদান করা হয় রাজশাহী অঞ্চলের জীবন্ত কিংবদন্তি ওস্তাদ রবিউল হোসনকে। এই পর্বটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় পাঁচশো মানুষের হূদয় ছুঁয়ে যায়। 'গুরুপ্রণাম ও পুষ্পবর্ষণ' অংশে লক্ষ্যাপার প্রশিক্ষণ প্রকল্পের ছয়জন শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে গুরুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর একে একে গুরুবরণ করা হয় মাল্যদান ও উত্তরীয় পরিধান করিয়ে। জীবনী ও মানপত্রপাঠ শেষে আজীবন সম্মাননা স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারী এসব কৃত্যে অভিভূত ওস্তাদ রবিউল হোসেন অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। চোখের জলের ধারায় এবং বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় জানান যে, তিনি এই সম্মানের যোগ্য নন। তিনি বলেন, 'লক্ষ্যাপারের এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত অঙ্গনকে জাগিয়ে তুলবে। আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দিলেন আপনারা। আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করছে।'
এরপর রাত ৯টা থেকে শুরু হওয়া শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন চলে পরদিন সকাল প্রায় নয়টা পর্যন্ত। শিল্পীরা ছিলেন প্রিয়াংকা গোপ, শুষেণ রায়, ওস্তাদ রবিউল হোসেন, মৃত্যুঞ্জয় দাস, সুপ্রতীক সেনগুপ্ত, লিও জে. বাড়ৈ, রেজওয়ানুল হক, কল্যাণ মুখোপাধ্যায় এবং ড. অসিত রায়। মাঝে নৈশভোজের বিরতি দেওয়া হয়। শিল্পী, শিক্ষার্থী, সংগঠক, সংবাদকর্মীসহ উপস্থিত প্রায় পাঁচশো শ্রোতাকে আপ্যায়িত করা হয় ভুনা খিচুড়ি, সবজি এবং ডিমের কোর্মা দিয়ে। ভাবতে অবাক ও দুঃখ লাগে যে এত তাত্পর্যপূর্ণ একটি আন্তর্জাতিক মানের শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলনের সেই অর্থে কোনো নামিদামি পৃষ্ঠপোষক নেই! তবু যে লক্ষ্যাপার থামবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। শুভকামনা তাদের প্রাপ্য।