'স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রমাদিই ছিলেন সর্বেসর্বা। কি নাচের তালিম, গানের রিহার্সেল সব কিছু্ই চলত রমাদি'র নেতৃত্বে। অনুষ্ঠানটা কেমন করে আগের বারের চেয়ে আকর্ষণীয় হবে-এসব বুদ্ধি বের হতো ওর মাথা থেকেই। আর রমাদি ছাড়া স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে-এটা ভাবাই যেতো না। আবৃত্তিতেও রমাদি'র কুশলতা ছিল সাবলীল। রমাদি সেই তখন থেকেই অর্জন করেছিলেন নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা। নাচ-গান-আবৃত্তি-অভিনয়-এসবের জন্য বছরে তার পুরস্কার ছিল বাঁধা।'
এভাবেই ছেলেবেলার সুচিত্রা সেনের কথা স্মরণ করেন পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এক ক্লাসে নিচে পড়া ডক্টর সফুরা নবী। ফোন করলে পুরনো অনেক তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআই) অবসরপ্রাপ্ত এই পরিচালক।
সুচিত্রা সেনের বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিণী। এই দম্পত্তির দ্বিতীয় মেয়ে রমা দাশগুপ্ত। যিনিই পরে সারা বিশ্বে পরিচিত হন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন হিসেবে। দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ের সুবাদে রমা দাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। পরে সিনেমায় যেয়ে নাম নেন সুচিত্রা সেন। মহাখালী পাঠশালায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন সুচিত্রা। তখন তার নাম ছিল কৃষ্ণা দাশগুপ্ত।
পাবনার বিখ্যাত আইনজীবী জগদীশচন্দ্র গুহ। তাদের বাড়িটি ছিল আজকের পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি যেখানে, ঠিক তার পূর্বে। দু'টো বাড়ি উত্তরে-দক্ষিণে। এখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন গুহ বাবু। তার ছেলেরা হলেন অমল গুহ পিনু, শ্যামল কৃষ্ণ গুহ। আর মেয়েরা হলেন রেবা গুহ, রেখা গুহ মিনা, কৃষ্ণা আর শিলা। জগদীশ চন্দ্রের বড় দুই মেয়ের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল সুচিত্রা সেনের।
জানা গেল আজকের প্রথিতযশা আইনজীবী শফিকুল ইসলাম শিবলীর মেজ বোন সারা আহমদ ছিলেন সুচিত্রা সেনের সহপাঠি। সেজ বোন ড. সফুরা নবী ছিল স্কুলে মহানায়িকার এক ক্লাসে নিচে। শিবলী বোনদের কাছে এবং রেবা গুহ ও মিনা চৌধুরীর কাছ থেকে সুচিত্রা সম্পর্কে যা জেনেছেন বললেন এই প্রতিবেদকে। তিনি জানান, 'রমাদির সাথে সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীতে এক সঙ্গে পড়েছেন মিনা ও রেবা গুহ। রেবা গুহ বর্তমানে সোদপুরে আছেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। রেবাদি'র সাথে রমার ঘনিষ্ঠতা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ছিল। মিনা চৌধুরীরা প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে খেলাধুলার জন্য যেতেন দিলালপুর মহল্লার চৌধুরীদের বাড়িতে। বিশাল আঙিনায় বৌচি ও এক্কা দোক্কা খেলা করতেন।'
শিবলী বলেন,'বাড়ি থেকে রেবাদিরা বেড়িয়ে যেতেন রমাদিদের বাড়িতে। রমাদির বের হতে সময় লাগতো বেশি। শাড়িটা সময় নিয়ে পড়া কিংবা আবার পড়ার জন্য বা টিপটা বদলে বদলে কপালে লাগানোর জন্য হয়তো সময় লাগতো বেশি। দল বেঁধে তারা যেত টেকনিক্যাল স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে পূর্বে চৌধুরীদের বাড়ির দিকে। পরে অন্য সহপাঠি যোগ দিতেন তাদের সাথে। চৌধুরীদের বাড়িতেই ছিল সেই সহপাঠি, রেজিয়া। ওই বাড়ির বড় ছেলে রওশনজান চৌধুরী বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরির উদ্দেশে না বের হওয়া পর্যন্ত সবাই হৈচৈ করতেন বান্ধবীর ঘরে। উনি বেড়িয়ে গেলেই শুরু হত খেলাধুলা।'
'রমাদিরা ছুটি ছাটায় বেশ ঘুরতেন। ভ্রমণ ছিল ওদের পরিবারে নৈমিত্তিক বিষয়। কলকাতাতেও ছিল অনেক আত্মীয়-স্বজন। এক পিসে মশাই ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। আত্মীয় বাড়িতে ঘোরাঘুরির একদিন রমাদি দিবানাথ বাবুর চোখে ধরা পড়েন এক ট্রামে। দিবানাথ বাবু ট্রাম থেকে পিছু নিয়ে রমাদির পিসে মশাই-এর বাড়ি দেখে যান। সে যাত্রা কনে দেখা ও আশীর্বাদে। সেবার কলকাতা থেকে রমাদি ফিরে আসেন দিবানাথ বাবুর বাগদত্তা হয়ে।'
শিবলী জানান, 'সাতচল্লিশে যখন রমাদি নবম শ্রেণীর ছাত্রী, তখন বিয়ে হয় তার। পাবনায়। স্কুলে তার সহপাঠিরাও বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল দুপুরে। দল বেধে স্কুল থেকে।'
শিবলী বলেন, মিনা চৌধুরী তাকে জানান, 'বধূর সাজে রমাদি'র সে ছবিটি আজো ভাসে আমার চোখে। অনেক রাতে বিয়ের লগ্ন থাকায় অনেকেই উপস্থিত থাকতে পারেননি। বিয়ের পর বরকে নিয়ে মাঝে মাঝেই রমাদি পাবনায় নাইওরে এসেছেন। ঈশ্বরদী থেকে বিশ্বাস কোম্পানির বাসে চেপে পাবনা শহর। সেখান থেকে রিকশায় বাপের বাড়ি।'
শিবলী বলেন, পথে জগদীশচন্দ্র গুহ'র বাড়িতে রিকশা থামিয়ে জামাইসহ রমাদি ঢুকে পড়তেন তাদের বাড়িতে। জ্যাঠা মশাইকে প্রণাম করে, জামাইকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অন্দর মহলে তখন জামাইয়ের জন্য সাজ সাজ রব। এদিকে রেবাদি'র সাথে চলতো নানা ফিসফিসানি। হাসাহাসি। বিয়ের পরও রমাদি স্কুলে গিয়েছেন। সহপাঠিদের সাথে মোলাকাত করবার জন্য। শিক্ষিকাদের প্রণাম করবার জন্য। পরে হয়তো সাংসারিক ব্যস্ততায়, বিশেষ করে মুনমুনের জন্মের কারণে আর পাবনায় আসা হয়ে ওঠেনি। দেশ বিভাগের কারণও থাকতে পারে। সেটা তখন বোঝা যায়নি।'
বর্তমানে রাজশাহীতে বসবাসরত শিবলীর মেজ বোন সারা আহমদকে ফোন করলে তিনি জানান, সেই ছোটবেলা থেকেই রমা ছিল পোশাকে আশাকে আলট্রা মডার্ন। ওর আচরণ ছিল সপ্রতিভ। তখনতো মুসলমান মেয়েরা পড়ালেখায় অতো এগিয়ে আসেনি। আর স্কুলের যত ফাংশন সেখানে লিড দিত রমা-ই।' ডক্টর সফুরা নবী জানান, সুচিত্রাদি'র বিয়েটা ছিল পাবনার টক অব দা টাউন। কারণ সুচিত্রার বিয়েতে কোন 'বরপণ' দিতে হয়নি। আদিনাথ সেন এসব পছন্দ করতেন না। তাছাড়া যত বরযাত্রী এসেছিলেন পাবনায়-তাদের যাতায়াত পাবনায় থাকা ও খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত আদিনাথ বাবু নিজের ব্যয়ে নিজের উদ্যোগে করেছিলেন। পণ না নেবার মানসিকতা ও সাহসিকতাই ছিল-টক অব দা টাউন। শিবলী জানান, ডাক্তার মিনার সাথে রমাদি'র আবার দেখা হয় ১৯৮৬ এর নভেম্বরে। মিনার বড়দা অমল গুহ তখন লেক টাউন প্রজেক্টের ডিরেক্টর। কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে পাবনার অনেক মানুষ কাজ করেছেন। এদের কাছ থেকেই রমাদি পাবনার পরিচিত মানুষদের খোঁজ খবর নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। জন্মভূমির টান বলে কথা। কেন পর্দার আড়ালে অন্তরালবাসিনী? এমন প্রশ্নের জবাবে খুবই সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবন যাপনকারী সুচিত্রা'র সাফ জবাব, দর্শক হূদয়ে আমি নায়িকা হয়েই বেঁচে থাকতে চাই। স্বপ্নের রানি হয়ে।'