সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ দিয়েছেন। জেনারেল জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সুযোগ দেন। আর 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল এএইচএম এরশাদ সংবিধানে সংযোজন করলেও বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকার তা সংবিধানে রেখে দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে 'ধর্মভিত্তিক বা ধর্মীয় নামযুক্ত' কোন রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ ছিল না। এ সম্পর্কে '৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, "জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তত্পরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।" মূল সংবিধানের এই বিধানের কারণে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি রাজনৈতি দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দল বিধিমালা নামে অধ্যাদেশ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। একইসঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল জিয়া ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদকে বদলে দেন। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, "জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ—সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।" ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যে শর্তাংশ ছিল জিয়াউর রহমান তা ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় সামরিক ফরমান আদেশ নং—৪ এর মাধ্যমে বাতিল এবং পরবর্তীতে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। এর ফলে ১৯৭৯ এর সংসদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান সরকারের জারিকৃত বিভিন্ন সামরিক আইন ফরমান আদেশ দ্বারা সংবিধানের যে সকল বিধান সংশোধন করা হয়েছিল সেগুলো অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে আপিল বিভাগ কতিপয় মার্জনা সাপেক্ষে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখে। তবে আপিল বিভাগ জিয়া সরকার কর্তৃক সংযোজিত ৩৮ অনুচ্ছেদের কোন মার্জনা দেয়নি। বর্তমান সরকার আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী ২০১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে ৩৮ অনুচ্ছেদটি '৭২ সালের মূল সংবিধানে যে রূপে ছিল সে রূপেই পুনঃস্থাপিত হয়। অর্থাত্ যে বিধানের কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায় সে বিধানটি সংবিধানে ফেরত আসে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ঘোষণা দেন যে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আর রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ বলেই গণ্য হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিন্ন কথা বলেন। এক সমাবেশে তিনি বলেন, তার সরকারের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের কোন চিন্তা নেই। পরবর্তীতে পঞ্চদশ সংশোধনীতে '৭২ সালের সংবিধানে 'ধর্মভিত্তিক ও ধর্মীয় নামযুক্ত' রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যে শর্তাংশ ছিল তা বাতিল করে দেয়া হয়। তার স্থলে অন্য কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এতে বলা হয়, "জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি— (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।" মহাজোটের শরীক বামপন্থি দলগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ সংক্রান্ত '৭২ সালের ৩৮ অনুচ্ছেদ সংযোজন ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এই বিধানটি বাতিলের জোর দাবি জানায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ দুটি বিষয়ে অনড় থাকেন। পরবর্তীতে জাসদ ওয়ার্কার্স পার্টি ও ন্যাপ এর আমেনা আহমেদ 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধন বিলে ভোট দেন।
প্রসঙ্গত, সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে ২ [ক] অনুচ্ছেদ সংযোজন করে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' এ বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে বলা হয়, "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।"
বেগম খালেদা জিয়া সরকার কয়েক দফা এবং শেখ হাসিনা একবার (পঞ্চদশ সংশোধনী) সংবিধান সংশোধন করলেও এরশাদ কর্তৃক সংযোজিত 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' এ বিধানটি রেখে দেন।