রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক মরিয়ম বেগম দুর্ঘটনায় তার ডান হাতটি হারান। কৃত্রিম হাত লাগানোর পর তার জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। চিকিত্সকরা বলেছেন, 'অনেক দামী হাত যত্ন করে রাখবে'। কিন্তু এটি কোন কাজে লাগেনি। দুর্ঘটনার নয় মাস পর তিনি জানান, এটির ওজন এতো বেশি যে, স্বাভাবিক জীবন যাপন আরো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ব্যবহার করার পর মনে হয়েছে যে কয়দিন বাঁচার আশা ছিলো তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
২৪ এপ্রিলের সেই দুর্ঘটনার ৫ দিন পর উদ্ধার হওয়া সুনিতা বলেছেন, আমি উদ্ধার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সরকারি কোন আর্থিক সহায়তা পাইনি। ডান হাত ভেঙ্গে যাওয়ার পর কোন কাজ করতে পারছিনা।
দুর্ঘটনায় নিহত মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রী তার দুর্বীসহ জীবনের কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অভাবের কারণে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া একমাত্র মেয়ের পাঠ্যপুস্তক কিনে দিতে পারছেন না তিনি। কিছু সাহায্য পেলেও দুর্ঘটনার পর এতগুলো মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও সরকারি কোন সহযোগিতা পায়নি তার পরিবার। রানা প্লাজায় তৃতীয় তলার কারখানায় কর্মরত ছিলো নির্মলা নামের এক শ্রমিক। তার বাবা বাদল আক্ষেপ করে বলেন, ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা দেয়ার পরেও এখন পর্যন্ত তার মেয়ের কোন হদিস কেউ দিতে পারে নি। তিনিও পাননি কোন আর্থিক সহযোগিতা।
'রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ও পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ: প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সর্বশেষ পরিস্থিতি' শিরোনামে আজ রবিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংলাপের আয়োজন করে। এসময় তার এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন। সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রমসচিব মিকাইল শিপার। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির ট্রাস্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
বক্তব্য রাখেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, সিপিডি'র সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও টিপু মুন্সি, বিকেএমইএ'র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিটিএমএ'র সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান মিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ, শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি'র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
বক্তারা বলেন, রানা প্লাজার ধসের পর সরকার, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ বিদেশি বায়ারদের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি এসেছে। কিন্তু কাজ হয়েছে অনেক কম এবং বিচ্ছিন্নভাবে। সকলের সমন্বয়ের স্বচ্ছতার সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তারা। তারা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারগুলো আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। দেশি-বিদেশি ক্ষতিপূরণের উদ্যোগও মাঝপথে থমকে আছে। কোথায় কত টাকা এসেছে এবং ব্যয় হয়েছে তার কোন পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরবর্তী এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, এটা ছিল মহা বিপর্যয়। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ বিপর্যয় কাটিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম। তৈরি পোশাক শিল্পে মান সম্পন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধক ব্যবস্থা তৈরি করতে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।
শ্রমসচিব মিকাইল শিপার আগত ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বক্তব্য শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করার আশ্বাস প্রদান করেন। তিনি সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার পর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া শ্রমিক পরিবারদের শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত ৭৭৭ জন শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের বিপরীতে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনে এ অর্থ ব্যবহারের চিত্র ওয়েবসাইটে দেয়া হবে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে অনেক কাজ হয়েছে সমন্বয়হীন ভাবে। নিখোঁজদের তথ্যে অস্বচ্ছতা রয়ে গেছে। তবে এ ধরনের বিপর্যয়ের পর আমাদের মাঝে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে। এ ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের পোশাক শিল্প গড়ে তুলতে হবে, যা আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের তৈরি পোষাক শিল্পের বাজারকে নেতৃত্ব দিবে।
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের তৈরি পোশাক কারখানার সবগুলোতে কমপ্লায়েন্স নেই। তিনি উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, বিদেশি সংগঠন একর্ড ও অ্যালায়েন্স যেভাবে পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে দেশের এই সেক্টর লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। তারা বলছে, ভবনগুলো বন্ধ করে দিতে। এমনটি করলে আগামী আগস্টের মধ্যে সব কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি বলেন, পোশাক শিল্পে রাজনীতি ঢুকে গেছে। কীভাবে বাংলাদেশ থেকে এই ব্যবসা চলে যাবে, সেই রাজনীতি চলছে। বিদেশি বায়াররা তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা কোন অর্থ প্রদান করেনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কী পরিমাণ অর্থ এসেছে এবং এ দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে কত টাকা কী খাতে ব্যয় হয়েছে সে তথ্য সকলকে জানানো প্রয়োজন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মূল উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিক ও পরিবারগুলোর জন্য প্রকারভেদে ১০-১৫ লাখ টাকা দেয়ার কথা। এ পর্যন্ত পেয়েছেন মাত্র ৪০ জন। দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সহায়তার অভাবে আজ এসব হতভাগ্য শ্রমিকের পরিবার, আহত শ্রমিক এবং হারানো শ্রমিকের পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে চারটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিলে শ্রমিকদের সহায়তা তহবিলে ৩২০ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে। বর্তমানে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ চলছে। দুঃখজনক হলো, দেশিয় পর্যায়ে এ উদ্যোগে কোনো পক্ষ এগিয়ে আসেনি। দীর্ঘ মেয়াদে আহত শ্রমিকদের সুচিকিত্সা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। সার্বিক বিবেচনায়, রানা প্লাজার হতভাগ্য শ্রমিক ও অন্যদের জন্য প্রথম ১০০ দিনের যে আশু উদ্যোগ এবং দ্রুত তত্পরতা দেখা গিয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালে ধরে রাখা যায়নি।