দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে না বলে উল্লেখ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা না কাটলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে আস্থার সংকট থেকেই যাবে। বিগত ছয় মাসে দেশের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বড় ৪ খাতে যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। টাকার অংকে ৪৯ হাজার ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অর্থবছরের ছয়মাসের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে হতে পারে।
গতকাল শনিবার সিপিডি কার্যালয়ে অর্থনীতির '২য় অন্তর্বর্তী পর্যালোচনা' শিরোনামে এক বিশ্লেষণ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা হয়। সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান ও সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ড. দেবপ্রিয় বলেন, বর্তমানে যে আপাত শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন ক্ষমতা আছে, কিন্তু পরিস্থিতিগত কারণে অচল হয়ে পড়েছিল কিংবা পুরোপুরি চলমান ছিল না সেগুলো সচল হবে বা সেগুলোর চলমান কার্যকারিতা বাড়বে। কিন্তু এটা আগামী দিনের নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাকে দূর করতে পারবে বলে মনে হয় না। অর্থনীতিকে সম্প্রসারণ করতে হলে নীতিগত অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। যেসব মধ্যমেয়াদী প্রকল্প গৃহীত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক সংলাপ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো নীতি গ্রহণ করা হলে সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে যায়।
সিপিডি'র বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ক্ষতির এই আর্থিক মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছে।
ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী যে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন ছিলো তা ধরে রাখা যায়নি। প্রবৃদ্ধির ত্বরণ হারিয়ে গেছে। উচ্চপ্রবৃদ্ধির সেই সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাজেটে নির্ধারিত সরকারের আয়-ব্যয়ের কাঠামো দ্রুততা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে পুনর্নিধারণ করা, শুধু রফতানিখাত নয় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহায়তা প্রদান এবং বিনিয়োগকে উত্সাহিত করতে নীতি অনিশ্চয়তা দূর করা।
অর্থনীতির বিভিন্ন খাত বিশ্লেষণ করে মুস্তাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন, রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অর্থবছরের বাকি যে সময় রয়েছে, তাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই এ লক্ষ্য কমিয়ে আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি ব্যাংকে উদ্বৃত তারাল্য বেড়েছে। এর অর্থহচ্ছে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে। বিগত সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে জালিয়াতি হয়েছে, তার প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে। ঋণ খেলাপিসহ জালিয়াতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোকে সরকার ৪ হাজার ১শ' কোটি টাকার তহবিল দিয়েছে, যা এসেছে দেশের মানুষের দেয়া কর থেকে। এর ফলে অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায়-ভার গিয়ে পড়ছে নতুন ঋণ গ্রহীতাদের ওপর বাড়তি সুদের বোঝা হয়ে।
বর্তমানে দেশে সাড়ে নয় লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে যা দুশ্চিন্তার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মজুতের এ পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ এবং তার আগের বছরের তুরলনায় ৩৮ শতাংশ কম। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে খাদ্যশস্যের মূল্য কম হওয়ায় আমদানি করে এ মজুত বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেন তিনি। দেশের রফাতানি খাতের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হলেও তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যখাতের রফতানির পরিমাণ আশানুরূপ নয়। সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার রপ্তানিকারকদের যে সহায়তা দিচ্ছে সে ধরনের সহায়তা অন্যখাতগুলোকেও দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।