
বারো বছরের ছেলে তূর্য সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার কাছে বায়না ধরেছে তাকে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের জার্সি কিনে দিতে হবে। তার অন্য বন্ধুরা এই জার্সি পরে ঘুরছে অতএব তাকেও জার্সি এনে দিতে হবে, তা না হলে সে বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। বাবা ছেলেকে বারবার বোঝাচ্ছে যে তোমাকে এই পোশাকে মানাবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তার গ্লাডিয়েটর্সের জার্সি লাগবেই। এমন চিত্র এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। এই অম্ল-মধুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বিপিএল। গোটা দেশ এখন এই জ্বরে আচ্ছন্ন। পিছিয়ে নেই তরুণরাও। নিজ নিজ দলকে এগিয়ে নিতে উত্সাহ-উদ্দীপনার যেন শেষ নেই। ঘরে-বাইরে চলছে কোন দল সেরা এই নিয়ে তর্কযুদ্ধ। এ নিয়ে তরুণদের আগ্রহটা যেন একটু বেশিই। ক্যাম্পাস, বন্ধুদের আড্ডা বা চায়ের দোকান সবখানেই চলছে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ফ্যাশন জগতও। ফেবারিট দলগুলোর জার্সি, টি-শার্ট, গেঞ্জিতে ছেয়ে গেছে ফুটপাথ থেকে শুরু করে নামীদামি ফ্যাশন আউটলেটগুলো। যে যার সামর্থ্য মতো সংগ্রহ করছে প্রিয় দলের জার্সি। এই বিপিএল জ্বরের জন্য ফ্যাশন আউটলেটগুলোও বেশ সরগরম। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ফেবারিট দলগুলোর জার্সির অরিজিনালিটি ধরে রাখতে বেশ ভালোমানের জার্সি উঠিয়েছে। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাই এর ক্রেতা। সে কারণে জার্সিগুলোও বেশ ভালো দামে বিকোচ্ছে। এই জার্সি বা টি-শার্টগুলো ফ্যাশনে এনেছে নতুন মাত্রা। এনেছে ফ্যাশনে নতুনত্ত্ব। কে কোন দলের কত বড় সমর্থক এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। পোশাক যেন এ ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেন এই সময়টার পুরো ফ্যাশন হাওয়াটাই বদলে দিয়েছে। সবকিছুই যেন এখন নিয়ন্ত্রণ করছে অংশগ্রহণকারী প্রিয় দলগুলোর জার্সির রং। আসলে ফ্যাশনকে প্রভাবিত করার জন্য মূলত নির্দিষ্ট কোনো টুর্নামেন্টের জন্য জার্সি ফ্যাশন নয়, সত্যিকার অর্থে উন্মাদনার প্রভাব কাজ করছে। এটা যদিও সাময়িক তার পরেও ফ্যাশনবাজারকে বেশ ভালোভাবেই নাড়া দেয়। অর্থাত্ খুব কম সময়ের জন্য একটা জোয়ার বয়ে যায়। তবে এটা দেশীয় ফ্যাশন বা গতানুগতিক ফ্যাশনকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। অবশ্য পোশাক-পরিচ্ছদের ভিন্নতা বিপিএল উত্তাপ আরও দ্বিগুণ করে তোলে।
আসলে খেলা দেখার আনন্দ গ্রাম-গঞ্জ-শহরের সব শ্রেণীর মানুষ সমানভাবে উপভোগ করে। প্রিয় দলের পতাকা উড়িয়ে আর প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবিযুক্ত পোশাক পরে মানুষ এই আনন্দযজ্ঞে সামিল হয়। কারণ প্রিয়দল ও খেলোয়াড়ের সাফল্যে নিজেকেও বিজয়ী মনে হয়। তাই দল বা খেলোয়াড়ের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের চিহ্ন পোশাকআশাকেও ফুটিয়ে তোলা হয়। বলা যায় এই মনোভাবের প্রভাব পড়ে ফ্যাশনেও। তাই এই বিপিএল মৌসুমে রাস্তাঘাটে জার্সি পড়া তরুণ-তরুণীরা নজর কাড়বেই। অবশ্য টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই প্রিয় দলগুলোর পতাকার মোটিফে করা টি-শার্ট নিয়ে সেজে উঠেছে ফ্যাশন হাউসগুলো। অনেক ফ্যাশন হাউস খেলোয়াড়দের ছবি সম্বলিত টি-শার্টও তৈরি করেছে। টুর্নামেন্ট চলাকালে এসব টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানোটাই আনন্দের। তবে জার্সি ছাড়াও আছে প্রিয় দলের পতাকা ও পতাকার রঙের কাপড়ে তৈরি পিঠের ঝোলা ব্যাগ। আবার রাবার ও র্যাক্সিনের ওপরে পতাকা ব্যবহার করে বানানো হয়েছে হাতের ব্যান্ড। মূলত, ক্রিকেট, ফুটবল বা টেনিস এই খেলাগুলো এখন আর নিছক খেলাতেই সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন বিনোদন ও উপভোগের অন্যতম মাধ্যমও বটে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্ল্যামার ও ফ্যাশনের ছোঁয়াও। কথায় আছে, 'প্রথমে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী।' খেলাতেও এ কথা এখন প্রযোজ্য। হালের জনপ্রিয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বিপিএলের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশের ইতিহাসে টি২০ ক্রিকেটের চর্চা খুব বেশিদিনের না হলেও জনপ্রিয়তায় খেলাটি অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গেই তুলনীয়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) তার বর্ণিল যাত্রা শুরু করেছে আর এর মাসখানেক আগে থেকেই আরম্ভ হয় আসর আয়োজনের কর্মযজ্ঞ। 'প্রচারেই প্রসার' বিপিএলকে জনপ্রিয় করতে ফ্যাশন বিষয়টি যে অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা রেখেছে সেটা বলাই বাহুল্য। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নতুন আসলে এ ধারণাটা এসেছে পাশের দেশ ভারতে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) থেকে।
দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর ভাবনায় স্বদেশের ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রবণতা শুরু থেকেই। নানা উত্সবে ফ্যাশন হাউসগুলোর অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই প্রশংসনীয়। তাদের কাজে স্বদেশের ভাবনা অনুপ্রাণিত করছে দেশ এবং ভিন্ন দেশের মানুষকে। ঠিক তেমনি ফ্যাশন ভাবনায় জার্সির আগমনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে এই ফ্যাশন হাউজগুলো। যেমন ঢাকার মিরপুরের পোশাক কারিগরদের কথা, মিরপুরের পোশাক কারিগরদের খ্যাতি নতুন নয়। তাদের ছোঁয়ায় জামদানি শিল্পিত ক্যানভাসে রূপ নিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু গত দশ, পনেরো বছরে এ এলাকায় গড়ে উঠেছে সারিবদ্ধ অসাধারণ কিছু বুটিক শপ। শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশ ঘেঁষেই এর অবস্থান। দেশের আলোচিত সব ফ্যাশন ব্র্যান্ড এখন ঠাঁই নিয়েছে এখানে। স্টেডিয়াম এলাকা রূপ নিয়েছে ফ্যাশন স্ট্রিটে। এককালের অবহেলিত মিরপুর এখন গরবিনী ফ্যাশন স্ট্রিট ধারণে। গত কয়েক বছরে বেইলি রোড, বনানী এগারোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৌকর্য ছড়াচ্ছে মিরপুরের দশ থেকে দুই নম্বর পর্যন্ত রাস্তাটি।
বিপিএল দোলায় নতুনভাবে সাড়া পড়েছে মিরপুরের বুটিক শপগুলোতে। ফ্যাশন হাউসগুলোও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল দর্শক সমর্থক ও ক্রেতাদের প্রয়োজন আর চাহিদা সামলাতে। খেলা দেখতে আসা দর্শকদের অনেকেই খালি হাতে ফিরে যাননি। খেলা দেখতে যাবেন আর গায়ে থাকবে না প্রিয় দলের জার্সি—এমন তো হওয়ার নয়। স্টেডিয়াম সংলগ্ন বুটিক শপগুলোতে ঢুকে পড়েছেন অনেকেই পছন্দের দলের জার্সি কিনতে। অঞ্জন'স, কে ক্র্যাফট, শ্রাবণ, বাংলার মেলাসহ বুটিক শপগুলোর বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে এ হাউসগুলোর মালিক, ব্যবস্থাপক আর কর্মীদের। শুধু জার্সি নয়। খেলাশেষে ফুর ফুরে মেজাজ আর পরের দিন মাঠে আসার প্রস্তুতিস্বরূপ অনেকে কিনেছেন টি-শার্ট, ফতুয়া আর পাঞ্জাবি। ক্রিকেটার, আয়োজকদের সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়েছে বুটিক শপগুলোর মালিক আর বিক্রয়কর্মীদের। নানা বয়সীদের জার্সি কেনার এই ভিড় অনেকটা চার-ছক্কার পর্বকেও ছাড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে ফ্যাশনে জার্সির ভূমিকাটি অনেকটা পোশাক শিল্পে নতুন চিন্তার আগমন ঘটিয়ে সৌন্দর্যের প্রাচুর্যতা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ।