টানা দুই রাতের নির্ঘুম চোখ। কণ্ঠস্বরে জড়তা। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবুও কী একটা শক্তি সবাইকে করে রেখেছে উজ্জীবীত। দুইদিন ধরে যেই কণ্ঠে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে 'রাজাকারের ফাঁসি চাই'। সেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠের শ্লোগান এখন আর শুধু শাহবাগে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলজুড়েই।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন দেশের সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার তরুণরা। মঙ্গলবার, বুধবারের পর আজ বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ চলছে পুরো উদ্যোমে। মঙ্গলবার বিকালে শাহবাগে শুরু হওয়া দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বাংলাদেশে। এই বিক্ষোভের সাথে সংহতি প্রকাশ করে দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই এখন বিক্ষোভ শুরু করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিককর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
দ্রোহের শ্লোগান, ক্ষোভ মিশ্রিত মিছিল, ঘৃণা মিশ্রিত বক্তব্য, প্রতিবাদী সমাবেশ, সড়কে চিত্রাঙ্কন, জনতার মঞ্চ স্থাপন, ফাঁসির মঞ্চে প্রতীকী যুদ্ধাপরাধীর ঝুলন্ত মরদেহ, মোমবাতি প্রজ্বলন, মশাল মিছিল, কুশপুত্তলিকা দাহ, সড়ক অবরোধ, অবস্থান কর্মসূচি, গণসঙ্গীত, প্রতিবাদী গান-বাজনা, জনতার এমন কোনো প্রতিবাদী কর্মসূচি নেই যা এই বিক্ষোভে পালিত হয়নি।
রাজধানীর বাইরে থেকে ইত্তেফাকের সংবাদদাতা, প্রতিনিধি ও ব্যুরো অফিসের পাঠানো খবর অনুযায়ী, দেশের সব বিভাগী শহরে ইতিমধ্যেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এছাড়াও যেসব জেলাতে এখনো কর্মসূচি হয়নি সেখানে বিকাল নাগাদ শুরু হবে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম অফিস:চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করেছে নগরীর সর্বস্তরের মানুষ। আজ বিকাল তিনটার দিকে কর্মসূচিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
খুলনা অফিস:যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এছাড়াও দুপুর একটার দিকে নগরীর সাতরাস্তার মোড়ে এবং বিকাল চারটার নগরীর প্রাণকেন্দ্র মহারাজ চত্বর এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এছাড়াও রাজশাহী, সিলেটেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারদণ্ডের শাস্তি ঘোষণা করলে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে দেশের বিভিন্ন স্তরের জনগণ। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে তরুণদের মধ্যে এ নিয়ে বেশি ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রায় পুনর্বিবেচনার দাবিতে দুপুরেই বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করে ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
বিকাল তিনটায় ব্লগার এন্ড অনলাইন একটিভিস্ট নেটওয়াকের্র উদ্যোগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের পর এ সংগঠনের উদ্যোগে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার তরুণরা। কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অবস্থান কর্মসূচি পরিণত হয় সড়ক অবরোধে। গতকাল বিকালে শাহবাগ মোড়ের এক পাশের সড়ক যান চলাচলের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। রাত পর্যন্ত সড়ক অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি চলছিল। গতকাল দিনে হাজারো মানুষ তাদের ক্ষোভ জানাতে শাহবাগে জড়ো হন। সন্ধ্যার পর জমায়েত বাড়তে থাকে। হাজারো মানুষের মুখে শ্লোগান-'এক দফা এক দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি দিবি', 'অন্য কোনো রায় নয়, কাদের মোল্লার ফাঁসি কেন নয়', 'ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই', 'আর কোনো দাবি নাই, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই', 'রাজাকারের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও', 'এই রক্ত কোনোদিন পরাজয় মানে না', 'আঁঁতাত নয়, ন্যায়বিচার চাই', 'রাজাকারদের সঙ্গে বসবাস করতে চাই না', 'একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার'।
মঙ্গলবারের ধারবাহিকতায় গতকাল ভোর থেকেই শাহবাগে জমায়েত হওয়া আন্দোলনরতদের সঙ্গে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ যোগ দিতে শুরু করেন। দিন যত গড়াতে থাকে মানুষ তত বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় শাহবাগ মোড় পরিণত হয় লক্ষ জনতার প্রতিবাদের কেন্দ্রস্থলে। দিন থেকে রাত-সারাক্ষণ কেউ গান গেয়ে, কেউ শ্লোগান তুলে, কেউ বক্তব্য দিয়ে দাবি তুলে ধরেন। অবিরাম প্রতিবাদী কর্মসূচিতে শাহবাগ মোড় হয়ে উঠে উত্তাল।
মশাল মিছিল:কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এরই অংশ হিসেবে গতকাল সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। মিছিলে সবাই শ্লোগান দেন-'যুদ্ধাপরাধের রায়, ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো সাজা নয়'। মিছিলটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহবাগে মিলিত হয়।
জনতার মঞ্চে ফাঁসি:গতকাল সকালে শাহবাগে জনতার মঞ্চ ও প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় ছোট এক নাটিকা মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আন্দোলনরতদের একজন বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক তানভীর রুসমত বলেন, কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছে তার দায়ে তাকে অন্তত চারশ'বার ফাঁসি দেয়া যেতে পারে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। আমরা ক্ষুব্ধ। প্রতীকী ফাঁসি দেয়া হলো। বাস্তবেও এ ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
'যুদ্ধাপরাধীরা সাপ':মঙ্গলবার রাতেই শাহবাগের সড়কে প্রতিবাদী আল্পনা ও চিত্রাঙ্কন করেন শিল্পী-শিক্ষার্থীরা। রাতেই তারা শাহবাগে কাগজের মাধ্যমে একটি 'সাপ' তৈরি করেন। বিশাল আকৃতির ঐ সাপ যেন গিলে খেতে চাইছে আশপাশের সবকিছু। এর নির্মাতারা জানালেন, 'সাপটি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী রূপ। যুদ্ধাপরাধ করে যেমন তারা স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি এখন দেশের উন্নয়ন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি করছে তাদের দোসররা। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিহত করতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য সাপ তৈরি ও প্রদর্শন করা হচ্ছে।'
'দ্রোহের প্রতীক শাহবাগ স্কয়ার' :কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের দাবিতে গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন ছাত্র-জনতা। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছিল। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। শাহবাগ মোড়কে তারা মিসরের তাহরির স্কয়ারের সাঙ্গে তুলনা করে নাম দিয়েছেন 'শাহবাগ স্কয়ার'। কেউবা এর নাম দিয়েছেব 'স্বাধীনতা স্কয়ার' কিংবা 'ন্যায়বিচার কেন্দ্রভূমি'।
গতকাল সকাল থেকেই আন্দোলনকারীরা গান গেয়ে, ঢোল বাজিয়ে, বক্তৃতা, শ্লোগানে তাদের দাবি জানান। দুপুরে যুদ্ধাপরাধীদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন আন্দোলনকারীরা। শাহবাগে আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে গতকাল সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেলিন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটির্র (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইসরাফিল আলম এমপি, সাংবাদিক আবেদ খান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি অধ্যাপক আবদুস সামাদ, আনিসুর রহমান মল্লিক, গোলাম কুদ্দুস, নারীনেত্রী শিরিন আখতার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী , ফকির আলমগীর প্রমুখ।
সন্ধ্যায় সাজেদা চৌধুরী সমাবেশস্থলে আসলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে দুপুরে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সংহতি জানান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বৃহস্পতিবার জাতীয় শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেয়া হবে না। ফাঁসির রায় নিয়েই ঘরে ফিরব। কর্মসূচিতে জনতার ঢল নামবে।'
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শাহবাগে আন্দোলনরতদের সাথে সংহতি জানাতে যান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি। সংহতি মঞ্চের দিকে তিনি যাত্রা করলে তাকে ঘিরে আন্দোলনরতরা বিক্ষোভ জানিয়ে স্লোগান দেন। আন্দোলনরতদের অনেকে উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, উনি (সাজেদা) কি বলতে এসেছেন আমাদের কারোর অজানা নয়। স্লোগান উঠে- এক দফা এক দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি দিবি বাংলার মাটিতে, রাজাকারের ফাঁসি হবে।
এরপর আন্দোলনরত জনতার উদ্দেশে সাজেদা চৌধুরী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সংসদ অধিবেশন থেকে এখানে ছুটে এসেছি। আপনাদের সকল বিষয় আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবো।
এদিকে ছাত্রলীগ আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে দাবি আদায়ের কর্মসূচি শিথিল করছে বলে অভিযোগ করেছেন বাম ধারার একাধিক সংগঠনের নেতারা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা।
শুক্রবার মহাসমাবেশ
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শাহবাগে সমাবেশ করা হবে। আর কাল শুক্রবার সকালে শাহবাগে মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে।
শুধু সংহতি নয়, অনড় অবস্থান
গতকাল রাতে আন্দোলনরতরা ঘোষণা দিয়েছেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে শুধু সংহতি জানানোই চলবে না, একইসাথে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনড় অবস্থান করবেন তারা। আন্দোলনরত তারেক আহমেদ জানান, আমরা অনেকেই আগে বন্ধু ছিলাম না, কিন্তু এ দাবিতে সবাই একই আত্মা। অনেকেই আমাদের দাবির সাথে সংহতি জানিয়েছেন। শুধু সংহতি নয়, আমরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনড় অবস্থান করব।
গতকাল রাতে আন্দোলনরতদের দাবির সাথে অন্যান্যের মধ্যে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটির্র সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী, ঝুনা চৌধুরী, রোকেয়া প্রাচী, এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ প্রমুখ।