বেবী নাজনীন। গান দিয়েই যার পরিচয়। অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে তার। আর গান দিয়েই তিনি জয় করেছেন কোটি কোটি ভক্তের হূদয়। কোকিলকণ্ঠী এই গুণী শিল্পীর বর্তমান ও ভবিষ্যত্ ভাবনা নিয়ে আমাদের মূল ফিচার। লিখেছেন মোর্শেদ নাসের
'ব্ল্যাক ডায়মন্ড' অথবা 'কৃষ্ণহীরক' শব্দটি সংগীত তারকা বেবী নাজনীনের শিল্পী জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এক অসাধারণ উপাধি। উত্তরবঙ্গে জন্ম নেওয়া এই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর মিডিয়ায় আরেকটি পরিচিতি রয়েছে 'উত্তরবঙ্গের দোয়েল' নামে। নিজের প্রাপ্ত এই উপাধিগুলো বেবী সব সময় এনজয় করেন। এই নিয়ে গর্বিত বেবী নাজনীন বেশ কয়েক মাস আমেরিকা-ইউরোপ ট্যুর কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। বললেন, 'আনুষ্ঠানিক কাজের বাইরে একটা বড় কাজ ছিল আমার একমাত্র পুত্র মহারাজ অমিতাভ সাঈদ এখন আমেরিকায় পড়াশোনা শুরু করেছে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই আছে আমার ছোট বোন সংগীত শিল্পী লিনি সাবরিন। ওর ওখানেই আপাতত রয়েছে। ছেলেকে ভর্তি করা হয়েছে নিউজার্সির রাটগার্ড ইউনিভার্সিটিতে।' সংবাদপত্রে দেখা গেছে দেশে ফিরেই বেবী নাজনীন চট্টগ্রাম ক্লাব আয়োজিত একটি কর্পোরেট ইভেন্টে পারফর্ম করতে। এর পরই শুরু হয়েছে তার ঢাকার কর্মময় জীবন। আইনজীবীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানেও বেবী গান করলেন ৩১ জানুয়ারি। এরই মাঝে সাংবাদিক সংগঠন সিজেএফবি প্রদত্ত পুরস্কার গ্রহণ করেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরীর হাত থেকে।
বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, অডিও এবং সমান তালে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো গায়িকা বেবী নাজনীন শুরু করেছেন তার ৫০তম একক অ্যালবামের কাজ। আমেরিকা এবং ইউরোপ যাওয়ার আগে এর অর্ধেক কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি। আগামী ঈদে হাফ সেঞ্চুরির এই অ্যালবামটি ভক্তমহলে পৌঁছে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। নিজের অ্যালবামে বেবী প্রায়ই একটা দুটো গান লিখে থাকেন এবং সুরারোপও করেন। কয়েক বছর আগে 'প্রিয়তম' নামে তার এক অ্যালবামেও একটি গানের কথা এবং সুর দিয়েছিলেন তিনি। সেই 'এক নজর না দেখিলে বন্ধু দুনিয়া আন্ধার হয়' গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় পায়। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—'মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে', 'ঐ রংধনু থেকে কিছু কিছু রং এনে দাও না', 'এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল', 'কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত', 'দুচোখে ঘুম আসে না তোমাকে দেখার পরে', 'আমার ঘুম ভাঙায়া গেলোরে মরার কোকিলে', 'লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে', 'পূবালী বাতাসে গো', 'ও বন্ধু তুমি কই কই রে এ প্রাণও বুঝি যায় রে' প্রভৃতি। তার নতুন অ্যালবামে আবার কোনো গান লেখার পরিকল্পনা আছে কি না—প্রশ্নটি উঠতেই বেবী জানালেন, 'অবশ্যই। তবে ভালো গান লেখার বিষয়টি খুব সহজ নয়। 'বন্ধু তুমি' লেখার পরেও আমার বেশ কয়েকটি একক অ্যালবাম বেড়িয়েছে কিন্তু আমি একটিও গান লিখিনি। বলা যায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এবার চেষ্টা করছি। আর আমি লিখলে তাতে সুরও আমারই করতে হয়।'
বেবী নাজনীন সংগীতমাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন অডিও এবং মঞ্চকে। তিনি বলেন, 'এই দুই মাধ্যমই একজন শিল্পীর শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রকৃত স্থান। তবে টেকনোলোজির যুগে নানা টেকনিক উপজীব্য করে অডিও মাধ্যমে সফল হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু সেই তাদেরকে যখন মঞ্চে সরাসরি গাইতে দেখা যায় তখন আর মেলানো যায় না। এর কারণ টেকনোলজির উপর অধিক নির্ভরশীলতা। টেকনোলজি ব্যবহার করে বানানো গানটি সেই শিল্পী যখন মঞ্চে গাইতে আসেন তখন তার আসল অবস্থানটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ মঞ্চে সরাসরি টেকনিক ব্যবহারের তেমন সুযোগ থাকে না। টেকনোলোজির সুবিধাগুলো অবশ্যই ব্যবহার করা যেতে পারে তবে শিল্পীর স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে নয়। তাতে শিল্পী জীবনের স্থায়িত্ব তৈরি করা কঠিন হয়ে ওঠে। একজন গুণী শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনে নিরন্তর সাধনার কোনো বিকল্প নেই। আমি এখনও সাধনা করি। গানের মাধ্যমে আমি বিশ্বের বহু দেশে আজও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। একটি বা দুটি গান দিয়ে তা করা যায় না। একজন শিল্পীকে সব রকম গান করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।' হ্যাঁ, বেবী নাজনীন শুধু একজন আধুনিক গানেরই শিল্পী নন, তিনি একইসঙ্গে বিচরণ করেন সংগীতের সকল মাধ্যমে। ক্লাসিক্যাল থেকে রবীন্দ্র, নজরুল, ফোক, আঞ্চলিক সব রকম গানেরই রেকর্ড রয়েছে তার। আধুনিক গানের ৪৯টি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে এই গায়িকার। বাংলাদেশে আর কোনো গায়িকার এই সংখ্যক আধুনিক গানের অ্যালবাম নেই। এর বাইরে ফোক এবং আঞ্চলিক গানের অ্যালবামও রয়েছে একাধিক। আর প্রায় সাড়ে তিনশ মিশ্র অ্যালবামে গেয়েছেন ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে। চলচ্চিত্র মাধ্যমেও গেয়েছেন হাজারেরও বেশি গান। অর্জন করেছেন একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা আর পুরস্কারে বেবীর বাড়ি পুরোদমে সাজানো। তার বাড়িতে গেলে দেখা যায় ফ্রেমে ফ্রেমে বাধা বিশ্বের অনেক সেলিব্রেটির সঙ্গে তার ছবি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেবী যে সব অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে গেছেন, একই অনুষ্ঠানে বেবীর পাশাপাশি পারফর্ম করেছেন এই সব তারকারা। বেবী সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী করেছেন। এর মধ্যে একাধিক ফ্রেমে পাওয়া যায় বেবীর আইডল আশা ভোঁসলেকে। দেয়ালে দেয়ালে আরও রয়েছেন এ আর রহমান, মান্নাদে, গোলাম আলী, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, কুমার শানু, জ্যাসমিন্দার নাড়ুলা, আলিসা চিনয়, হৈমন্তি শুক্লা, সনু নিগম, সাবেক সিএনএন টক শো হোস্ট ল্যারি কিং, মার্কিন কংগ্রেস ম্যান জোসেফ ক্রাউলিসহ বিশ্বের খ্যাতনামা মানুষেরা। তাদের সঙ্গে বেবীর অনেক স্মৃতি রয়েছে সেসব আরেকদিন জানাবেন বললেন। সঙ্গীতময় বর্ণাঢ্য এই ক্যারিয়ার নিয়ে তৃপ্ত ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন তার ভক্তমহলের কাছে সব সময়ই কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের মিডিয়ার কাছে। যারা তার মূল্যায়ন করেছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। বর্তমান প্রজন্মের গান কেমন লাগে জানতে চাইলে বেবী নাজনীন বলেন, 'এই প্রজন্মের শিল্পীদের গান নিয়ে আমি খুব আশাবাদি। আসলে একটা জেনারেশন যাবে, আরেকটি জেনারেশন আসবে। পুরোনোদের জায়গা ছেড়ে দিতে হবে, নতুনরা জায়গা করে নেবে। এখন যারা কাজ করছেন, তারা সুন্দর সুন্দর কাজ করছেন। অনেক ভালো ভালো কাজ করছেন। তবে একটা জিনিস আমি বলব, একজন শিল্পীকে একটু সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। আর ভালো শিল্পী হতে চাইলে তাকে গানের সাধনায় লেগে থাকতে হবে। আর প্র্যাকটিসের কোনো বিকল্প নেই।' ভক্তদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আসলে ভক্তদের জন্যই আমি। আমি একা কিছু নই। আমি আমারও নই। আমার ভক্তরা যতদিন থাকবে আমিও ততদিন বেঁচে থাকব। আমার ভক্তরা না থাকলে আমি থাকব না। এই বাঁচা আমার একার নয়, আমার ভক্তদের নিয়েই বাঁচা। আমার ভক্তদের জন্য আমার কামনা থাকবে তাদের সুন্দর, সুস্থ এবং আনন্দময় জীবন। তাদের স্বপ্নগুলো পূর্ণ হোক এবং তারা আমাকে বেশি করে আশীর্বাদ করুক এবং দোয়া করুক - এটাই আমি চাই। আমার ভক্তদের নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই।'