'ক্ষ' একটি বাংলা যুক্ত বর্ণ। এ নামেই দেশ-বিদেশে সকল বাঙালির মাঝে সমাদৃত হয়েছে ব্যান্ডটি। যেহেতু ব্যান্ডটি বাংলা গানের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মিউজিককে যুক্ত করেছে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে, তাই এ যুক্তাক্ষরটিতেই ফুটে উঠেছে ব্যান্ডটির মূল বৈশিষ্ট্য। এরই মাঝে এই ব্যান্ড নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলেও জনপ্রিয়তার পথে ব্যান্ডটি এগিয়ে গেছে স্বমহিমায়। ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা ও মেধাবী সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে গানের ভুবনে। এই ব্যান্ড নিয়ে লিখেছেন রিয়াদ খন্দকার
নাগরিক জীবনের অসহায় একাকিত্ব, দিশেহারা ব্যস্ততা ও আকাশ কুসুম কল্পনার চাদর যখন বাস্তবতার চাপে কুঁচকে যায় তখন সেখানে দেশপ্রেমের ছবিটি সহজে চোখে পড়ে না। তবু যেন কিছু কথা কিছু গান থেকে যায়, যা এখনও সময়ের ভাঁজ খুলে দেশপ্রেমকেই স্পষ্ট করে তোলে। আর এমনই একটি গান আমাদের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। যার সুরে বাংলাদেশের সব মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে বুক টান করে দাঁড়াতে শিখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি তাই আমাদের অহঙ্কার আমাদের গর্ব। সম্প্রতি এ গান গেয়ে 'ক্ষ' ব্যান্ড আলোচনায় এসেছে। তাদের উপস্থাপনা ও সংগীতায়োজনে নতুনত্ব নিয়ে অনেক বিতর্কও চলছে। ইতি ও নেতির বিচারের বাইরে থেকেই বলা যায়, গানটির শ্রুতিমধুরতাই শ্রোতাদের বিশেষ আকর্ষণ করেছে। পরিবেশনায় ও সুরের উঠানামায় 'কী শোভা, কী ছায়ার' প্রশান্তি থেকে উচ্চলয়ে উঠতে উঠতে 'ওমা ফাগুনে তোর', 'ওমা অঘ্রানে তোর' অংশের ক্লাইমেক্সের সপ্তমার্গে যেন দেশপ্রেমের হাহাকার সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তারা। তাই বলতেই হয় 'ক্ষ' এই প্রজন্মের কাছে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি নতুন রূপে পৌঁছে দিয়েছে, সুদূর লন্ডন থেকে স্পর্শ করতে পেরেছে আমাদের দেশপ্রেমকে। প্রায় সারে চার মিনিটের এই গানটি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই মুখরিত ছিল সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো। গানের প্রধান গায়িকা সোহিনী আলম ছাড়া বাকি সবাই বিদেশি এবং তাদের পারফর্মেন্সও ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। মিউজিক ভিডিওটি পরিচালনা করেছেন শাহরিয়ার রহমান। এই গানটি নিয়ে বয়ে যাওয়া নানা আলোচনা-সমালোচনাকে মাথায় রেখে বলা যায় 'ক্ষ'র এই পরিবেশনা হয়তো সময়ের বিবর্তনেরই ফলাফল। আর স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবর্তন কারও ভালো লাগবে হয়তো কারও ভালো লাগবে না। যাই হোক এই বিতর্ক আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আপাতত জেনে নিই 'ক্ষ'র আদ্যোপান্ত।
'ক্ষ' ব্যান্ডের যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে। এর সদস্যরা হলেন সোহিনী আলম, বেন হিলিয়ার্ড, হাসান মহিউদ্দিন, দেরেক স্ক্রাল। 'ক্ষ' চিরায়ত বাংলার সুর নিয়ে কাজ করছে। ব্যান্ড হিসেবে তারা প্রথম কনসার্টটি করে ২০০৮ সালে লন্ডনে। তখন থেকেই ইংল্যান্ডে 'ক্ষ' দলটি নিয়মিত হাজির হয়েছে শ্রোতাদের সামনে। দলটিতে সোহিনী ছাড়া অন্য সব সদস্যই ব্রিটিশ। যেহেতু বাংলা গান করবে বলে ঠিক করে দলটি, তাই বাংলা নামই খুঁজছিল তারা। যেহেতু ব্যান্ডের অনেক সদস্যই বাংলাদেশি নন, তাই ভালো একটি নাম খুঁজতে গিয়ে পছন্দ হয় 'ক্ষ' অক্ষরটি। এই যুক্ত বর্ণের মাঝেই নিজেদের যুক্তি খুঁজে পান তারা।
সোহিনী জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যে আর বড় হয়েছেন লন্ডন এবং ঢাকা মিলিয়ে। তার মা হীরন আলমের কাছেই তার সা-রে-গা-মা'র হাতেখড়ি। এরপর তালিম নিয়েছেন প্রখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী খালা জান্নাত আরা ও ফেরদৌস আরার কাছে। তার বয়স যখন ৯ তখন বাংলাদেশে আসেন। ছিলেন প্রায় সাত বছর। পারিবারিক আবহে তার বুকে বাংলা গানের বীজ বুনে দেয়। সেই বাংলা সুুরের লতায়-পাতায় জড়িয়ে নিয়েছেন জীবনকে। সোহিনী অ্যাঞ্জেলো ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি একই সাথে ক্ষ, লক্ষ্মীট্যারা এবং আফটার আর্টের ভোকাল। এর পাশাপাশি নৃত্য, চলচ্চিত্র ও থিয়েটারেও গান করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে রেডিও-টিভিতে তিনি পারফর্ম করছেন। কিশোন খানের লক্ষ্মীট্যারার ভোকাল হিসেবে ২০১০ সালের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসের শেষদিনে গান করেন তিনি। ২০১২ সালে দুইবার রনি স্কটজের মূল স্টেজে পারফর্ম করেন। এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে তিনি পারফর্ম করেছেন। সোহিনী প্রথমদিকে নজরুল সংগীত শিখলেও পরে ফোক, রবীন্দ্র ও আধুনিক গানের উপর কাজ করেছেন। এর বাইরে ইংরেজি, স্প্যানিশও গেয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া বিভিন্ন থিয়েটারেও কণ্ঠ দিয়ে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন, এর মধ্যে কঞ্জুস, সিনড্রেলা ও পিপলস রোমিও উল্লেখ্যযোগ্য। ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় তার সম্পর্কে লেখা হয়—শক্তিশালী কণ্ঠ, সেই সাথে নিজস্ব ভঙ্গি সব মিলিয়ে জাদুবলে শ্রোতাদের মন কেড়ে নিয়েছেন সোহিনী। 'দ্য লাস্ট ঠাকুর' এবং 'লাইফ গোজ অন' চলচ্চিত্রে তিনি আবহ সংগীত ছাড়াও কণ্ঠ দেন ধারা বিবরণীতে। ব্যান্ডের অন্য দুই প্রধান সদস্য অলিভার এবং ভ্যান দুজনেই মিউজিকের ওপর পড়াশোনা করেছেন। তারা বাংলা মিউজিকেও দক্ষ। বর্তমানে তারা মৌসুমী ভৌমিকের পারাপার ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছেন। অলিভার মিউজিক নিয়ে ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করেছেন এবং ভারতের মাটিতে থেকে বাউল সংগীতের ওপর পিএইচডি করেছেন।
মূলত গান পবিত্র। গানের সুরই পারে ধর্ম-বর্ণ-ভাষার ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে মানুষের হূদয়কে স্পর্শ করতে।
কারণ সব মানুষের মন সুরের সুতোয় বাঁধা। সুরের এই শক্তি আর মূর্ছনা না থাকলে পূজোয় কখনোই সুর করে মন্ত্রপাঠ হতো না, শত শত মানুষ আজান শুনে আবেগে আপ্লুত হতো না, রবিবারগুলো গীর্জা পঠিত বাইবেলের সুরে গমগম করত না। সুর ও স্রষ্টার সম্পর্ক অনেক স্পষ্ট। গানের পরিবেশনা যেমনি হোক তা যদি তার ধারায় মানুষের মন জয় করে নিতে পারে আবেগে নাড়া দিতে পারে তাতেই তার সফলতা। সুতরাং গান নিয়ে ধনাত্মকভাবে চিন্তা করাটাই শ্রেয়! যুগের প্রভাব গানেও পড়বে সেটাও মাথায় রাখতে হবে। তবে 'ক্ষ'র গানের পক্ষে বা বিপক্ষে যারাই আছেন তারা সকলেই যে গান ভালোবাসেন তা অনস্বীকার্য।