আধুনিক যুগে কি কেউ তার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রেমপত্র লিখেন? বাস্তবতা অনুযায়ী বিষয়টা খুবই হাস্যকর হবে। কম্পিউটারে বসে ভালোবাসার মানুষটির সাথে ফেসবুকে চ্যাট করার সময় হঠাত্ই ভাবনাটা মাথায় আসে জিসানের।
—তোমার বাসা চিনি কিন্তু ঠিক কোন ঠিকানা লিখলে তোমার বাসায় চিঠি যাবে তা তো জানি না।
—চিঠি যাবে মানে? জিসানের কথা শুনে নীতু তো পুরোই অবাক।
—তোমাকে চিঠি লিখব ভাবছি।
—মাথা নষ্ট হয়নি তো তোমার? এ যুগে কি কেউ চিঠি লিখে? তুমি না হয় আমাকে চিঠি পাঠালেই, কিন্তু সেই চিঠি রাখব কোথায়?
নীতুর কথা শুনে দমে গেল জিসান। নাহ, সত্যিই চিঠি লেখা অনেক ঝামেলার কাজই। তারচেয়ে মোবাইলে মেসেজ করা কিংবা মেইলে মনের কথা লিখে পাঠানো অনেক সহজ। আর যখন তখন ফেসবুকে চ্যাট করার অপশন তো আছেই। এত ঝামেলা করার কী দরকার?
নীতুকে চিঠি লেখার ইচ্ছা বাদ দিলেও প্রেমপত্র লেখার ইচ্ছাটা দমাতে পারে না জিসান। কী করে দমাবে? সেই ছোট্ট বেলায় দেখে এসেছে পাড়ার বড় ভাইরা কী সুন্দর মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠি লিখতেন। চিঠিতে হাতের লেখা যাতে সুন্দর থাকে সেজন্য কত শত কাগজ ব্যয় করতেন তারা। জিসানের মনে পড়ে—এই শতকের শুরুর দিকের অনেকগুলো আলাদা কিন্তু একই মেরুর ঘটনার। একুশ শতকের শুরুতে, মানে ২০০০ কি ২০০১ সালেও প্রেমপত্র লেখার হিড়িক ছিল। তারও আগের কবুতরে চিঠি পাঠানোর প্রচলন হয়তো তখন ছিল না, কিন্তু প্রেমপত্র লেখার এবং তা ভালোবাসার মানুষটির কাছে পৌঁছে দেবার যে আবেদন ছিল, তা এক কথায় অনবদ্য। জিসানের এলাকার বড়ভাই হিমেল। ভার্সিটিতে পড়তেন। চতুর্থ বর্ষে পাড়ার সময় হঠাত্ই প্রথম বর্ষের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যান। মেয়েটির নাম লতা। হিমেল ভাই অনেক দিন লতা আপুর পিছু নিয়েছেন। শেষে বুদ্ধি করে তাদের বন্ধু মহলে নিজেকে যুক্তও করেছিলেন, কিন্তু লতা আপু যখন তার সামনে আসতেন, তখনই সবকিছু ভুলে যেতেন তিনি। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, চিঠি লিখে মনের কথা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু কীভাবে প্রেমপত্র লিখবেন সেটাই তো জানা নেই তার। শেষে দ্বারস্থ হলেন, তারই সহপাঠী মকবুল ভাইয়ের। এই মকবুল ভাই আবার প্রেমপত্র লেখার ওস্তাদ। বন্ধুদের নিঃস্বার্থের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় প্রেমপত্র লিখে দেন, অথচ নিজেরই কোনো গতি করে উঠতে পারেননি। মকবুল ভাই হিমেল ভাইয়ের হয়ে লতা আপুকে চিঠি লিখে দিতেন। হিমেল ভাই সেই চিঠিগুলো লতা আপুর হোস্টেলের ঠিকানায় পোস্ট করে দিতেন। এভাবে তিন-চার মাস কেটে গেলেও লতা আপুর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। ওদিকে মকবুল ভাইও হিমেল ভাইয়ের হয়ে বেনামি চিঠি লিখতে লিখতে ক্লান্ত। শেষে একদিন চিঠির ফাঁকা জায়গাতে নিজের নাম লিখে দিলেন। আর তারপরই ঘটল মজার ঘটনা। লতা আপুর সহপাঠী রেহানা আপু মকবুল ভাইয়ের সামনে এসে হাজির। গত চার মাস ধরে মকবুল ভাইয়ের চিঠি পেয়ে আসছেন তিনি, শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে মকবুল ভাইয়ের কাছে ধরা না দিয়ে পারেননি! রেহানা আপুর কথা শুনে মকবুল ভাই পুরোই অবাক। শেষে আসল ঘটনা বের হলো—হিমেল ভাই লতা আপুকে এতদিন ভুল ঠিকানায় চিঠি লিখে আসছিলেন। আর সেই চিঠি গিয়ে পড়ত রেহানা আপুর কাছে! পরে যেদিন হিমেল ভাই জিসানকে ঘটনা খুলে বললেন, সেদিন তো ওর হাসতে হাসতেই পেটে খিল ধরার অবস্থা। জিসানের মনে পড়ল আরও কয়েকটি ঘটনা, ওর বড় ভাই রাসেলের নামে পাড়ার আঁখি আপু একটা চিঠি লিখেছিলেন, আর সেই চিঠি গিয়ে পড়ল ওর বাবার হাতে! শেষে রাসেল ভাইয়াটার কী অবস্থায়ই না হয়েছিল। ওর খালাতো বোন রোকসানা আপুর রায়হান ভাইয়ের সাথে বিয়ের পরে যখন শ্বশুর বাড়িতে গেলেন, তার তিন মাস পরে তাদের বাসার ভেন্টিলেটরের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো কয়েক শত চিঠি। আঁখি আপুর যে রায়হান ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল, সেটা ওই ঘটনার আগ পর্যন্ত কেউ জানতেই পারেনি! জিসানের মনে পড়ে, ছোটবেলায় প্রেমপত্র বিলি করে কত চকোলেট পেত তার হিসেব করা যেত না। সে সময়ের প্রেমিক-প্রেমিকারা মনে আশঙ্কা নিয়ে একে অপরকে চিঠি লিখতেন, সেই চিঠি পৌঁছানোর জন্য অনেক কষ্ট করতেন, তারপরেও সেই চিঠি সঠিক গন্তব্যে যেত কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যেত। এখন সেই কষ্টের দরকার নেই। কি-বোর্ডের কয়েক চাপেই মনের কথা পৌঁছে যাচ্ছে মনের মানুষের কাছে।
জিসানের মতো আরও অনেক প্রেমিক হূদয় হয়তো এখনো তাদের ভালোবাসার মানুষটির থেকে প্রেমপত্র পাওয়ার আশা করে থাকে, কিন্তু বাস্তবতা যে এখন অনেক বিপরীত স্রোতে...।