আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঘোলাজলে চলিতেছে জাতিগত সহিংসতা। সেই সহিংসতায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর কয়েক লাখ মানুষ দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছে প্রাণরক্ষার জন্য। খ্রিস্টান-অধ্যুষিত দরিদ্রপীড়িত সাবেক ফরাসি উপনিবেশ এই দেশটিতে খ্রিস্টান দাঙ্গাবাজরা সমপ্রতি অন্তত ২০০ মুসলিমকে হত্যা করিয়াছে। সেলেকা নামে পরিচিত দেশটির উত্তরাঞ্চলের মুসলিম বিদ্রোহী গোষ্ঠী গত বত্সর মার্চে এক দশকব্যাপী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কোয়িজ বোজিজকে উত্খাত করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষোভ ছিল ওই আন্দোলনের প্রধান কারণ। তাহার সহিত ধর্মের সংশ্লেষ ছিল না কোনো অর্থেই। ইহার কয়েক মাস পর ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের অনুগত 'অ্যান্টি-বালাকা' নামের খ্রিস্টান বিদ্রোহীরা প্রতিশোধপরায়ণ হইয়া ওঠে। অতঃপর গত ডিসেম্বর হইতে তাহারা মুসলিম বিদ্রোহীদের সমর্থিত সরকারকে উত্খাত করিতে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড চালাইতে থাকে।
'অ্যান্টি-বালাকা'র সদস্যরা এতটাই নৃশংস যে, তাহাদের অকথ্য অত্যাচারে দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছে হাজার হাজার মুসলমান। দেশটির সর্বাধিক জনবহুল পশ্চিমাঞ্চলে গত দুই মাসে মুসলমান সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে চলিতেছে 'জাতি নির্মূল' প্রক্রিয়া—যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও স্পষ্ট করিয়া এই কথাই বলিয়াছে। দেখা যাইতেছে, যেই সকল মুসলমানরা পলায়নে বিলম্ব করিতেছেন, তাহাদের হত্যা করা হইতেছে নৃশংসভাবে। বিস্ময়ের কথা হইল, খ্রিস্টান সন্ত্রাসীরা দেশটির মুসলমানদের অভিহিত করিতেছে 'ভিনদেশি' হিসাবে। অথচ শত শত বত্সর ধরিয়াই ওই অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাস করিয়া আসিতেছে সেখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ। জাতিসংঘ মনে করিতেছে, দেশটিতে সামপ্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি যেই পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে তাহার তুলনায় আন্তর্জাতিক সাড়া খুবই অপ্রতুল। এই সহিংসতা প্রতিরোধ, বেসামরিক মুসলিমদের সুরক্ষা, আইনের শাসন প্রবর্তন, মানবিক সহায়তা ও দেশটির ঐক্য বহাল রাখিবার বিষয়টি এক্ষণে আমলে না লইলে তাহা সম্পূর্ণই নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইতে পারে। আফ্রিকা মহাদেশে 'মানবতা' শব্দখানি এমনিতেই মুখ লুকাইয়া থাকে। অত্যাচার-দাঙ্গা-অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষেরা যেন একে অপরের মাংস ছিঁড়িয়া খাইতে চাহে, সহিষ্ণুতার ছিঁটেফোঁটাও নাই, দখলবাজি, মারামারি-কাটাকাটি যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু, তাহার নেপথ্য কারণ খুব সরল নহে। মৌচাক থাকিলে সেইখানে যেমন হিংস্র ভালুকের থাবা খুব সাধারণ ঘটনা, কয়েক শত বত্সর ধরিয়া আফ্রিকার মানুষও শোষণ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হইতেছে তাঁহাদের প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে। এই সম্পদের দখল লইয়া চলিতেছে নানাবিধ দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নাটক। অদৃশ্যে কলকাঠি নাড়িতেছে যাহারা, তাহাদের ধর্ম নাই, বর্ণ নাই, জাতি নাই। তাহারা ধর্মে-ধর্মে বিভেদ লাগাইয়া, প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীকে নানা কৌশলে লেলাইয়া দিয়া ঘোলাজলে মত্স্যশিকার তথা গোপন-উদ্দেশ্য হাসিল করিতেই ব্যগ্র। ঔপনিবেশবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় লইবার পরও নানা অজুহাতে পঞ্চাশ বারেরও অধিক প্রত্যক্ষ ফরাসি সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটিয়াছে আফ্রিকায়। গত ডিসেম্বরের শুরুতে সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে এই দাঙ্গা দমনে ও কথিত শান্তি আনয়নে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছিল ফ্রান্স। ফরাসি সৈন্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও এইখানে দাঙ্গা প্রশমিত হইবার লক্ষণ নাই। সুতরাং তাহাদের কথিত সদুদ্দেশ্য লইয়া প্রশ্ন আরও বৃহত্ হইতেছে বটে।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের চারিদিকের দেশসমূহও নানাভাবে অস্থিতিশীল। সুদান ও দক্ষিণ সুদানের অন্তর্দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্র হইতেছে। কঙ্গো, ক্যামেরুন, চাদ কিংবা কিয়দদূরের উগান্ডা, ইথিওপিয়া বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ মানব-ইতর জীবনযাপন করে। এই মহাদেশে অশিক্ষা ও দারিদ্র্যকে জিইয়ে রাখিয়া প্রভাববলয় অক্ষুণ্ন রাখিতে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র নূতন নহে। সেই ষড়যন্ত্রে প্রাণ যায় যুগ যুগ ধরিয়া সহাবস্থানে থাকা ভিন্ন ভিন্ন সমপ্রদায়ের মানুষের। কালো আফ্রিকার জন্য ইহা বড় ট্রাজেডি।