অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ

আবেগের চূড়ান্ত ও নিঃশর্ত অভিব্যক্তি যার ফলে অস্তিত্ব ও অধিকার সৃষ্টি হয় তার নাম 'প্রেম' বা 'ভালোবাসা'। এ উপলব্ধিতে হূদয়ের কথা বলবার ব্যাকুলতায়—'প্রাণ, মন, দেহ' প্রেমাষ্পদের কাছে সপে দেওয়া যায়। ভালোবাসার লোকজ রসায়ন— "ঋণচিন্তা রোগচিন্তা সংসারচিন্তা সকল চিন্তা দর / যৈবনকালে পীড়িতচিন্তা সকল চিন্তার বড়"।। (মৈমনসিংহ গীতিকা)। কেননা, ভালোবাসা একটি স্বর্গীয় অনুভূতি এবং মহামতি প্লেটোর ভাষায় "প্রেমের পরশে সবাই কবি হয়ে যায়"। ইংরেজি প্রবাদ: Love means not having to say you are sorry। প্রেমের পবিত্র সৌধের গাঁথুনি মজবুত করেছে নানান উপাখ্যান। রোমান লোককথায় আছে, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তাঁর সৈন্যদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ করলে এক প্রেমানুরাগী যাজক গোপনে সৈন্যদের বিয়ে দেওয়া শুরু করেন। সম্রাট তাঁকে কারাগারে পাঠান। কিন্তু যাজকের সেবা, ভালোবাসা ও চিকিত্সায় 'কারাপ্রধানে'র কন্যার অন্ধত্ব দূর হয়। অন্যদিকে রাজনিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধে যাজকের মৃত্যুদন্ড হয় । ঐ যাজক মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে যে শেষ বার্তা পাঠান তা হলো- Love from your' VALENTINE' । ঘটনাটি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের। আর ৪৯৬ খ্রিঃ রোম সম্রাট জেলুসিয়াস্ ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদিন ১৪ ফেব্রুয়ারিকে 'ভ্যালেন্টাইন ডে' ঘোষণা করেন। যা বর্তমানে 'বিশ্ব ভালোবাসা দিবস' হিসেবে পালিত হচ্ছে। কানাডার প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী জন অ্যালান লি প্রেম ও ভালোবাসার কয়েকটি 'রোমান-গ্রীক' ধারার প্রকরণ বর্ণনা করেছেন, যার সহজতর শিরোনাম (নিজস্ব)— (ক) লুডাস্ Ludas:'কুসুমকুসুম ভালোবাসা' (খ) ইরস্ Erose:'উতলা ভালোবাসা' (গ) ম্যানিয়া Mania:'অন্ধভালোবাসা' (ঘ) প্রাগমা Pragma:'সচেতন ভালোবাসা' (ঙ) স্টর্জ Storge:'সুপ্ত ভালোবাসা' (চ) এগ্যাপী Agape:'স্বর্গীয় ভালোবাসা'। মানুষের মনোদৈহিক প্রবণতা প্রকারভেদ ও পরিমাপে ব্যাখ্যার বিষয় না হলেও (ক) স্বভাবগত (খ) গুণগত (গ) আদর্শগত ভালোবাসা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। অন্যদিকে ভালোবাসা ও ভালোলাগার পার্থক্য করাও কঠিন। কারণ, ভালোলাগার অর্থ আরাম, সৌন্দর্য আবার ভালোবাসা অর্থ সুখ, নির্ভর-নির্ভার বা পরিতৃপ্তি। জুতা অথবা খাবার প্রসঙ্গে শব্দগুলোর যে তাত্পর্য একজন মানুষের প্রতি ভালোলাগা অথবা ভালোবাসা বোঝানোর তাত্পর্য কিন্তু অন্য রকম উপলব্ধির প্রকাশ। কলামকে ভালোবাসার স্থান কুকুর প্রীতির সমার্থক নয়। আবার মায়ের প্রতি ভালোবাসার আবেগ প্রেমিক-প্রেমিকার যুগল অনুভূতির দু'য়ে মিলে একজন-একমন, একপ্রাণ হওয়ার চেয়ে ভিন্ন কিছু। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে মহান আল্লাহ্ ও রসূলের (স.) প্রতি নিবেদিত ও নিঃশর্ত। কেননা, ভালোবাসার অপার শক্তিতে মহান আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। আবার মহান আল্লাহর করুণা নির্ঝরণী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তাই মহান আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রতি ভালোবাসার মূল্য অপরিসীম ও বিপুল-বিশাল। ঈমানদারের ভালোবাসা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বাণী—"বিশ্বাসীর বন্ধন আছে আল্লাহর / ভালোবাসার এইরূপ ছেদ নাহি যার"।। আল্লাজিনা আমানু আসাদ্দু হুব্বালিল্লাহ্ অর্থাত্ 'মু'মিনদের সর্বাধিক (মুহাব্বত) প্রেম হবে আল্লাহরই জন্য' (বাকারা:১৬৫)। আবার আল্লাহর ভালোবাসা পাবার জন্যই ভালবাসতে হবে প্রিয়নবী (স.)কে। কেননা, মহান আল্লাহর বাণী "(বলুন) যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তবে (আমি রসূল) আমার আনুগত্য কর। তবেই আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন" (আল-ইমরান: ৩১)। ভালোবাসা লৌকিক ও আদর্শগত কারণে সৃষ্টি হয়। আর প্রিয়নবীর (স.) আদর্শ অনুসরণ করাই হলো তাঁর প্রতি ভালোবাসার উপায়। এজন্যই প্রিয়নবী (স.) বলেন "তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না 'আমি' ভালোবাসার দিক থেকে তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্তোতি ও দুনিয়ার সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় (বিবেচ্য) না হবো" (বুখারি-মুসলিম)। প্রিয়নবীর (স.) প্রতি ভালোবাসা ঈমানি পূর্ণতা ও পারলৌকিক মুক্তির শর্তে যুক্ত। প্রিয়নবীর (স.) প্রতি আবেগ ও আকর্ষণ এক অমূল্য অনুভূতি। পবিত্র কুরআনের বাণী— "ঈমানদারদের কাছে তাদের জীবন অপেক্ষাও রসূল অধিক প্রিয়" (আহ্যাব:০৬)। আবার প্রিয়নবীর (স.) প্রতি ভালোবাসা, তাঁর আদর্শ অনুসরণের শিক্ষা ও পারলৌকিক সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা দেয়। এজন্যই প্রিয়নবী (স.) বলেন "যে আমার আদর্শকে (সুন্নাহ্) ভালোবাসল, সে যেন আমাকেই ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল সে আমার সঙ্গেই জান্নাতে বসবাস করবে" (মেশকাত)। প্রিয়নবীর (স.) প্রতি ভালোবাসার কারণেই- প্রিয়নবীর (স.) নিদ্রা ভঙ্গের আশংকায় হিজরতের সময় সাপের গর্তের মুখে পা চেপে রেখেছিলেন আবু বকর (রা.)। হিজরতের কঠিন সময়ে মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত 'নবীগৃহে' বিছানায় শুয়ে ছিলেন আলী (রা.), আমানতের মাল ফেরত্ দেওয়ার জন্য ওমর (রা.) চিত্কার করে বলেছিলেন "আমি আপনাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসি"। প্রিয়নবীর (স.) প্রতি ভালোবাসা ও আহ্বানে সাড়া দিয়ে 'তাবুকের যুদ্ধে' ওসমান (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং আবুবকর (রা.) তাঁর সম্পদের সবটুকু নিবেদন করেছিলেন। প্রিয়নবীর (স.) প্রতি ভালোবাসার কারণেই আবু হুরাইরা (রা.) পেটে পাথর বেঁধেও 'মসজিদে নব্বী'তে অবস্থান করতেন, প্রিয়নবীর (স.) কথা শুনতেন, তাঁকে (স.) দেখতেন এবং তাঁকে (স.) হুবহু অনুসরণ করতেন। আর প্রিয়নবীর (স.) ওফাতে 'নবীবিহীন' মদীনা বেলাল (রা.) মেনে নিতে পারছিলেন না। কথিত আছে, ওয়েছকর্ণী (রা.) উহুদের যুদ্ধে প্রিয়নবীর (স.) আহত হওয়ার খবরে 'নিজের দাঁত নিজেই ভেঙ্গে দিয়েছিলেন'। বস্তুতঃ ভালোবাসা নিছক একটি দিবস পালনের সীমাবদ্ধ আবেগ বা বিদেশী সংস্কৃতির সঙ্গে আপোষ রফার নাম নয়। বরং ভালোবাসার চেতনা একটি সার্বক্ষণিক বিষয় এবং ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে মহান আল্লাহ্ ও রসূলের (স.) আদর্শ অনুসারে। জৈবিক ভালোবাসা নয় বরং ঈমানি-তাওহিদি ভালোবাসার বিশ্বাস, বাক্য ও ব্যবহারের দ্যুতিতে অন্ধকার হারিয়ে যাক সত্যের মোহনায়— এটাই ইসলামের আলোকিত ও শাশ্বত আহ্বান।
লেখক :অধ্যাপক, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর