বন্ধুত্ব সত্স্বভাবের ফলশ্রুতি। সত্স্বভাবই পরস্পরের মধ্যে প্রীতি-ভালোবাসা এবং সুসম্পর্কের মূল। আর অসত্ স্বভাবই পরস্পরের মধ্যে দ্বেষ, হিংসা এবং শত্রুতার মূল। স্বভাব উত্তম এবং প্রশংসনীয় হলে তার ফলও উত্তম এবং প্রশংসনীয় হয়। ধর্মের মধ্যে সত্স্বভাবের মাহাত্ম্য ও ফজিলত গুপ্ত বিষয় নয়। আল্লাহতায়ালা তাঁর নবীকে এভাবেই উত্তম সম্বোধন করেছেন: "ইন্নাকা লা আলা খুলুক্বিন আজীম" অর্থাত্ নিশ্চয়ই আপনি সত্চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি আরও বলেছেন: যে গুণ অধিকসংখ্যক মানুষকে বেহেশতে পৌঁছে দেবে, তাহল আল্লাহভীতি ও সত্স্বভাব। হযরত ওসমান (রা.) বলেছেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ (স.)! মানুষকে কোন উত্তম গুণটি দান করা হয়েছে? তিনি বললেন, উত্তম স্বভাব। তিনি আরও বললেন, ঐ সত্স্বভাবের পূর্ণতার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, মীযানে যা সর্বাধিক ওজনের বস্তু হবে, তা সত্স্বভাব। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহতায়ালা কোন মানুষের স্বভাব এবং আকৃতি এরূপ সৃষ্টি করেননি যে, আগুন তা দগ্ধ করবে। অর্থাত্ যার স্বভাব-চরিত্র ও আকৃতি-প্রকৃতি সুন্দর, তাকে দোযখের আগুন দগ্ধ করতে পারবে না। হুজুরে পাক (স.) হযরত আবু হোরায়রা (রা.)কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে আবু হোরায়রা! তোমার সত্স্বভাব অবলম্বন করা উচিত। তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সত্স্বভাব কি? তিনি বললেন, যে তোমার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সে বন্ধন অটুট রাখবে। যে তোমাকে অত্যাচার করে তুমি তাকে ক্ষমা করবে। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান করবে। সত্স্বভাবের ফলশ্রুতি যে বন্ধুত্ব ও নির্জনতা বর্জন তা কোন গুপ্ত বিষয় নয়। ফল উত্পাদনকারী বৃক্ষ উত্তম হলে, তার ফল উত্তম হবে, তা অবিসংবাদিত। বন্ধুত্বের প্রশংসা সম্বন্ধে ওপরে যে বাণীগুলো উদ্ধৃত হল এর মাহাত্ম্য ও ফজলিত সম্পর্কে তা-ই যথেষ্ট। যখন পরহেজগারী, ধর্ম এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসার লক্ষ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন হয়, তখন তার ছওয়াব অনেক গুণ বেশি হয় এবং তা আল্লাহর কুরআন এবং রসূলের হাদীস দ্বারাই উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহতায়ালা বন্ধুত্বের নেয়ামতের ফলে সৃষ্টির ওপর তাঁর অসীম অনুগ্রহ প্রকাশ করে বলেছেন, দুনিয়ায় যা আছে তা সব যদি ব্যয় করে ফেল তবু তুমি তাদের হূদয়ে স্মৃতি স্থাপন করতে পারবে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের পরস্পরের হূদয়ে স্মৃতি স্থাপন করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, তাঁরই অনুগ্রহে তোমরা ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছ। তারপর তিনি বিচ্ছিন্নতাকে ভর্ত্সনা ও নিন্দা করেছেন। আল্লাহ বলেন, "ওয়াতাছিমু বিহাবলিল্লাহি জামীআও অলা তাফাররাকু" অর্থাত্ তোমরা আমার রজ্জুকে একত্র হয়ে মজবুতভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। রসূলে পাক (স.) এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ লোক আমার সর্বাধিক নিকটবর্তী, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সত্স্বভাব বিশিষ্ট। সুরক্ষিত স্থানে চলাফেরাকারিগণই বন্ধুত্ব করে এবং বন্ধুত্ব পায়। তিনি আরও বলেছেন, মুমিন ব্যক্তি অপরকে ভালোবাসে এবং অপরের ভালোবাসা পায়। যে ব্যক্তি ভালবাসে না এবং ভালোবাসা পায় না তার মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্বের প্রশংসা জ্ঞাপনেচ্ছলে বলেছেন, আল্লাহ যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকে তিনি একজন ধার্মিক বন্ধু দেন। যদি সে ভুলে যায়, সে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যদি তার স্মরণ থাকে, সে তাকে সহায়তা করে। তিনি আরও বলেছেন, যখন দু'ভ্রাতার মধ্যে সাক্ষাত্ হয়, তখন তাদের দৃষ্টান্ত দুটি হস্তের মত বলা চলে। একটি হস্ত অন্য হস্তের ময়লা পরিষ্কার করে দেয়। দু'জন মুমিনের পরস্পর সাক্ষাত্ হলে, আল্লাহ একজন দ্বারা অন্যজনের উপকার করান। আল্লাহর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের উত্সাহ দেয়ার জন্য হুজুরে পাক (স.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ব করে, আল্লাহ তাকে বেহেশতে পদমর্যাদা বহুগুণে বর্ধিত করে দেবেন এবং তার আমল থেকে কোন কিছু হরাস করবেন না। হযরত আবু ইদরীস হাওলানী, হযরত মুআযকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসি। শুনে তিনি বললেন, খুবই উত্তম। আমি হযরত রসূলে করীম (স.) কে বলতে শুনেছি, একদল লোকের জন্য রোজ কেয়ামতে আরশে মুআল্লার চতুর্দিকে আসন স্থাপন করা হবে। তাদের মুখমণ্ডল পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় উদ্ভাসিত হতে থাকবে। সেদিনের মহা বিভীষিকায় লোকগণ ভীত হবে; কিন্তু তারা ভীত হবে না। লোকগণ সন্ত্রস্ত হবে, কিন্তু তারা সন্ত্রস্ত হবে না। তারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনরূপ ভয়-ভীতি, দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না। তখন আরজ করা হল, ইয়া রসূলাল্লাহ (স.)! তারা কোন লোক? তিনি বললেন, যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে। হুজুরে পাক (স.) এরশাদ করেছেন, আরশে মুআল্লার চতুর্দিকে নূরের মিম্বর অবস্থিত থাকবে। তার ওপরে একদল লোককে উপবিষ্ট দেখা যাবে, তাদের পোশাক হবে নূরের তৈরি এবং তাদের মুখমণ্ডলও হবে নূরদ্বারা নির্মিত। তারা কিন্তু নবী রসূল বা শহীদ নয়; কিন্তু নবী-রাসূল ও শহীদগণ তাদের পদমর্যাদা দেখে ঈর্ষান্বিত হবে। হুজুরে পাক (স.)-এর নিকট আরজ করা হল, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমাদের নিকট তাদের গুণ বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে একত্রে মজলিসে বসে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে সাক্ষাত্ করে। হুজুরে পাক (স.) আরও বলেছেন, আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু'জন লোক পরস্পরকে ভালোবাসলে তাদের মধ্যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু'বন্ধুর মধ্যে যখন একজন অন্যজন অপেক্ষা অধিক পদমর্যাদাসম্পন্ন হয়, তখন তার সঙ্গে অন্যজনকেও তার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং সে তার সঙ্গে একত্রেই থাকতে পারবে। যেমন সন্তানগণ তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে একত্র থাকে এবং যেরূপ এক পরিবারের লোকগণ একে-অন্যের সাথে মিলেমিশে কালযাপন করে। এর কারণ হল, যখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব বা ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়, তা বংশগত বা রক্ত সম্পর্কিত ভ্রাতৃত্বের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, তাদের সন্তানগণকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করব এবং তাদের আমল থেকে কোন কিছু হরাস করা হবে না। হুজুরে পাক (স.) এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে, তাদের জন্য আমার সাহায্য সুনিশ্চিত হয়। হুজুরে পাক (স.) আরও বলেছেন, আল্লাহতায়ালা রোজ কেয়ামতে বলবেন, আমারই উদ্দেশ্যে যারা পরস্পরকে ভালো বেসেছিল তারা আজ কোথায়? আজ আমার ছাঁয়া ব্যতীত কোন ছাঁয়া থাকবে না। আমি তাদেরকে আমার ছাঁয়ায় স্থান দান করব। রসূলে করীম (স.) আরও বলেছেন, সাতজন লোককে আল্লাহ তার আরশের ছাঁয়ায় স্থান দান করবেন। যেদিন তার ছাঁয়া ব্যতীত অন্য কোন ছাঁয়া থাকবে না। ঐ সাতজন লোক হল: (১) সুবিচারক শাসনকর্তা, (২) আল্লাহর ইবাদাতে নিমগ্ন যুবক, (৩) ঐ ব্যক্তি, যে মসজিদ থেকে বের হয়ে পুনরায় প্রবেশ করা পর্যন্ত মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট থাকে, (৪) এমন দু'ব্যক্তি, যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, তজ্জন্য তারা মিলিত হয় এবং তারা পরস্পর সাহচর্য অবলম্বন করে, (৫) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং যার ফলে তার নেত্রযুগল হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়, (৬) ঐ ব্যক্তি, যে কোন সম্ভ্রান্ত বংশীয়া সুন্দরী যুবতীর কুপ্রলোভনে সাড়া না দিয়ে বলে,আমি আল্লাহকে ভয় করি, (৭) ঐ দাতা যে কোন কিছু দান করে তা গোপন রাখে, এমন কি যা তার দক্ষিণ হস্ত দান করেছে তার বাম হস্তও তা টের পায়নি। হুজুরে পাক (স.) আরও বলেছেন, আল্লাহর প্রতি অনুরক্ত হয়ে এবং তার সাথে সাক্ষাতের আশা করে কেউ কারও সাথে সাক্ষাত্ করলে, জনৈক ফেরেশতা তার পেছন থেকে বলে, তুমি ধন্য, তোমার পদক্ষেপকে ধন্যবাদ এবং তোমার জন্য নির্ধারিত বেহেশতকে ধন্যবাদ। রসূলে করীম (স.) এরশাদ করেছেন, একদা জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের মনস্থ করলে, আল্লাহতায়ালা জনৈক ফেরেশতাকে গোপনে তার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেশতা ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মনস্থ করেছ? সে বলল, আমি আমার বন্ধুর সাথে সাক্ষাত্ করবার মনস্থ করেছি। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, তার কাছে কোন প্রয়োজন আছে কি? সে বলল, না। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, তার সাথে তোমার কোন আত্মীয়তা আছে কি? সে বলল, না। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, সে তোমার কোন উপকার করেছে কি? সে বলল, না। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, তবে কোন প্রয়োজনে তুমি তার সাথে সাক্ষাতের মনস্থ করেছ? সে বলল, আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমি তার সাথে ভালোবাসা স্থাপন করেছি। ফেরেশতা বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা আমাকে তোমার নিকট এ সংবাদ দিতে প্রেরণ করেছেন যে, তিনি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন, কেননা তুমি তাকে ভালোবাস এবং আল্লাহ তোমার জন্য বেহেশত সুনিশ্চিত করে রেখেছেন। হুজুরে পাক (স.) আরও বলেছেন, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা স্থাপন করা দৃঢ়তর ঈমানের পরিচায়ক। এজন্যই মানুষের বন্ধু থাকা চাই, যেন সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদেরকে ভালোবাসতে পারে। আল্লাহতায়ালা হযরত দাউদ (আ.)-এর নিকট অহী পাঠালেন, হে দাউদ! তুমি মানব সমাজ ত্যাগ করে নির্জন স্থানে চলে এলে কেন? তিনি বললেন, হে মাবুদ! আমি তোমার সন্তুষ্টির আশায়ই এ নির্জনতা অবলম্বন করেছি। আল্লাহ বললেন, হে দাউদ! তুমি সতর্ক হয়ে যাও। নির্জনতা ছেড়ে বন্ধুর অন্বেষণে লিপ্ত হও। যে ব্যক্তি আমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তোমার সহায়ক না হয়, তাকে তুমি বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। কেননা সে তোমার শত্রু, সে তোমার হূদয়কে কঠিন করে ফেলবে এবং আমাকে তোমার নিকট থেকে দূরে রাখবে।