ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উত্কর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। বাংলা সাহিত্যের আদি সৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূল ছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলা সাহিত্যের আদি ছড়া বললেও ভুল হবে না।
আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত। লোক সমাজে ছড়াই ছিল ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্য সাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়ারে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—'ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য'। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—ছড়া বাংলা সাহিত্যের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তার 'লোক সাহিত্য' গ্রন্থে ছড়াকে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া—এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে এই তিন শ্রেণীর ছড়াই বর্তমান। লৌকিক ছড়ায় রচয়িতার নাম নেই। সাহিত্যিক ছড়ার উপশ্রেণী শিশুতোষ ছড়া আর আধুনিক ছড়া কালের কৌশলকে মেজাজ ও রস বহন করে। তবে আধুনিক ছড়া সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে, বলা হয়—সমাজ সচেতন বা সমাজ বাস্তবতাকে নিয়ে রচিত ছড়াই আধুনিক ছড়া। এ কালের সাহিত্য গবেষকরা জোর গলায় বলে থাকেন—ছড়া কাস্মিনকালেও ছেলেভোলানো বা শিশুতোষ ছিল না। এমনকি শিশুদের জন্য কখনও সৃষ্টি হয়নি। তবে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে শিশুদের কাছে। আর যেহেতু ছড়া মুখে কাটার বিষয়, সেহেতু ছন্দ-মিলের বিষয়টি শিশুদের কাছে বেশি পছন্দনীয়। তাই বলে চর্যাগীতিকার প্রথম পদটি কি ছোটদের জন্য রচিত? কিংবা বর্গী-তাড়ানো ছড়া 'ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো' ছড়াটি বর্গীর ভয়ের কথা বলা হলেও এটি ঐতিহাসিক বিষয়কে নিয়ে কোনো এক অজানা ছড়াকার ছড়া কেটেছিলেন। এই ছড়াটি টিকে আছে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এবং মানুষের মুখে মুখে।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন 'খুকুমণির ছড়া' এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ছড়া-সম্রাট সুকুমার রায় ছড়ার বিভাজন করেন ঠিকই, কিন্তু তাদের ছড়ার সমাজ বাস্তবতা খুব সচেতনভাবে ধরা পড়েছে। কবি জসিম উদ্দীন, সুনির্মল বসু, অন্নদাশংকর রায় প্রমুখের ছড়া-কবিতা বহুল পঠিত ও সমাদৃত।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর অন্নদাশঙ্কর রায় সমাজ বাস্তবতাকে নিয়ে প্রচুর ছড়া-কবিতা লেখেন। কিন্তু পূর্ববাংলার ছড়া লেখকগণ এই সময় শিশুতোষ ছড়া রচনায় মশগুল থাকেন। কিন্তু '৫২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আমাদের কবিতা ও ছড়ার নতুন দিক নির্দেশনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষাদের দশকে এর উন্মেষ ঘটে প্রবলভাবে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ছড়া হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রধান হাতিয়ার। আগেই বলেছি ছড়া সমাজ জীবনের চিত্রাচিত্রণের উপযুক্ত মাধ্যম। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও টিপ্পনীর মাধ্যমে ছন্দ-মিলের কথা সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যের গৌরবের কাল হলো ষাটের দশক। এ সময় প্রকাশিত হয় এখলাস উদদীন আহমদ সম্পাদিত 'ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ' রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত মাসিক কচি কাঁচার বহুরঙা বুলেটিন, আখতার হুসেন ও আবু সালেহ সম্পাদিত চিচিংফাঁক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদ প্রকাশিত ঊনসত্তরের ছড়া এবং পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তাকে নিয়ে লেখা হয় হাজার হাজার ছড়া। এভাবেই সচেতন বিষয়কে আশ্রয় করে রচিত হয় আধুনিক ছড়া-কবিতা। এসব ছড়া-কবিতা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে ছড়ার বিষয়, ছন্দ, মিল শব্দ প্রয়োগের মাধুর্যের কারণে। বাংলা সাহিত্যের লৌকিক ছড়ার-কবিতার রচয়িতাদের হদিশ আমরা পাই না। তারা ছড়া-কবিতায় লোকজ শব্দ ও লোকজ ছন্দের মিলন ঘটিয়েছেন। আমাদের আজ ঠিকানা লোকাশ্রিত পাড়া গাঁয়ে। এ কারণেই লোকজ ছড়া বা লৌকিক ছড়া-কবিতা আজও পাঠকপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশঙ্কর রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আতোয়ার রহমান প্রমুখ লৌকিক ছড়ার শব্দ ও সুরকে আধুনিকীকরণ করে ছড়া-কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু লৌকিকতা পরিহার করতে পারেননি। লোকশব্দ, লোকছন্দ ও লোকসুর তাদের ছড়া-কবিতাকে আরও পরিপক্ক করে তুলেছে।
ঁবাংলা সাহিত্যের ছড়া লেখকদের তালিকা সুদীর্ঘ এবং তারা আপন বৈশিষ্ট্যে স্বখ্যাত। ছড়ার প্রাণ হলো ছন্দ ও মিল। সঠিক শব্দের প্রয়োগে ছড়ার বিষয় আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একসময় ছড়া ছিল ধ্বনিনির্ভর ও অন্তমিল সংযুক্ত। কালের আবর্তে ছড়ার আধুনিকীকরণে ধ্বনি ও মিলের সাথে শব্দের সঠিক ব্যবহার ছড়াকে আরও ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। এখানে বাংলা সাহিত্যের নামজাদা ছড়া-লেখকের কিছু ছড়ার আংশিক উদ্ধৃতি দিলেই বিষয়টি আরও সহজ হবে। নিচের প্রথম ছড়া বা পদটি চর্যাগীতিকার কাহ্নপাদের লেখা। ভাষা তথা শব্দ ও মিলের অপূর্ব সাঁকো তৈরি করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন :
চর্যাপদ
আলিএঁ কালিএঁ বাট
তা দেখি কাহ্নু বিমণা ভইলা
কাহ্নু কহিঁ গই করিব নিবাস।
জো মণ গোর সো উআস
শব্দ ও মিলের অপূর্ব নিদর্শন রবীন্দ্রনাথের খাপছাড়া। প্রতিটি ছড়ার অন্তমিলে দুই মাত্রা এবং বিষয় বর্ণনায় যুত্সই শব্দের প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে এর আগে কেউ করেননি। তিনি লিখেছেন :
ক্ষান্তবুড়ির দিদি-শাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কালনায়,
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
হাঁড়িগুলো রাখে আল্নায়।
কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে,
নিজে থাকে তারা লোহা সিন্দুকে,
টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে বলে
রেখে দেয় খোলা জাল্নায়—
নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে, চুন দেয় তারা ডাল্নায়।
অনুরূপভাবে কাজী নজরুল ইসলাম তার ছন্দ-মিলের দক্ষতা দেখিয়েছেন কুলি-মজুর কবিতায়। তিনি লিখেছেন :
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা'ব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে—
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগত্ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!
ছড়া-সম্রাট সুকুমার রায় কম কিসে। তার ছড়া-কবিতার পাঠক ছোট-বড় সবাই। তিনি খাওয়া নিয়ে ছড়া কেটেছেন এভাবে!
খাই খাই করো কেন? এসো বসো আহারে
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত খুশি খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে
জড়ো করে আনি সব—থাকো সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ চর্ব্য ও চোষ্য
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি।
উপযুক্ত শব্দের ব্যবহার ও ছন্দের গাঁথুনিতে বর্ণনা হয় হূদয়গ্রাহী। কবি জসিম উদ্দীনের পল্লী জননী তার অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তিনি লিখেছেন :
রাত থম্ থম্ স্তব্ধ নিঝুম, ঘন ঘোর আঁধিয়ার
নিঃশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম্ ঘুম্ যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
ছড়া রচনায় অন্নদাশঙ্কর রায় ছন্দ মিলের আশ্রয়ে বিষয়ের প্রতি জোর দিয়েছেন বেশি। তার ছড়া-কবিতা তাই চিন্তাশীল, অপরদিকে সকলের জন্য লেখা। 'খোকাখুকু' ছড়াটিতে তিনি লিখেছেন :
তেলের শিশি ভাঙল বলে,
খুকুর পরে রাগ করো?
তোমরা যেসব বুড়ো খোকা,
ভারত ভেঙে ভাগ করো?
তার বেলা
ভাঙছো প্রদেশ ভাঙছো জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ি
পাটের আড়ত, ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ি-
তার বেলা?
সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া-কবিতায় ছন্দ মিলের পাশাপাশি বিষয়ের প্রতি অটুট ভাবনা দৃষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে শব্দের সঠিক ব্যবহার তিনি সচেতনভাবে করেছেন 'ঠিক আছে' ছড়াটিতে তিনি লিখেছেন :
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
রেসনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
সাম্প্রতিক বিষয়কে নিয়ে এখলাসউদ্দিন আহমদ, রফিকুল হক, মাহবুব তালুকদার, আখতার হুসেন, মাহমুদ উল্লাহ, আবু সালেহ, শাহাবুদ্দীন নাগরী, রোকেয়া খাতুন রুয়ী, ফারুক নওয়াজ, লুত্ফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেছেন। এদের ছড়া-কবিতায় ছন্দ-মিলের অর্পূব দ্যোতনা এবং শব্দের সঠিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। শুধু বিষয়ই নয়, শব্দ-ছন্দের কারুকাজ প্রতিটি পঙিক্ততে পঙিক্ততে গাঁথা। যেমন লুত্ফর রহমান রিটন লিখেছেন শাহবাগের ছড়ায়:
গোলাম রে তোর হবে ফাঁসি
সোনার বাংলা ভালোবাসি
যারা হাত মিলিয়েছে ঘাতকের সঙ্গে
তাদেরও বিচার হবে জানি এই বঙ্গে।
ছড়ার শরীর নির্মাণের জন্য পদ্যকার ও গদ্যকারের মতো ছড়া-লেখকের অভিধানের দ্বারস্থ হতে হয় না। কিংবা অভিধান ঘেঁটে বেছে বেছে একগুচ্ছ শব্দ টেবিলে নিয়ে বসতে হয় না। লৌকিক ছড়ার সৃষ্টিকর্তারা আদিতে মুখে মুখে ছন্দ, শব্দ ও মিল খুঁজে পেতেন আধুনিককালের ছড়া-লেখকরাও পূর্বসূরিদের মতো ছড়া নির্মাণ করেন। তবে সাহিত্যের যেকোনো সৃষ্টির মাধ্যমে হওয়া উচিত গ্রহণযোগ্য ভাষা। পদ্যে রহস্যময়তা থাকে,
কিন্তু ছড়ার বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হতে হয়।
ছড়ার শব্দ-ঝঙ্কারই পাঠককে বিমোহিত করে এবং ছড়ার চলার গতি আপন ছন্দে-আনন্দে। শব্দের সাঁকো তার আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায়।