গানের বিষয় হতে পারে ভাষা, এটি একটি অদ্ভুত ধারণা মনে হবে পৃথিবীর অনেক জাতি-গোষ্ঠীর কাছেই। যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান কিংবা ভারত। ভুটানের সরকারি ভাষা জঙখা হলেও সে দেশের আরও দুয়েকটি প্রধান আঞ্চলিক ভাষা কারও না জানা থাকলে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে তার চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়ে। আবার কেউ কারও নিজস্ব ভাষার গুরুত্ব কমিয়ে সরকারি ভাষায় আকৃষ্ট হওয়ারও ইচ্ছা নেই। কারণ ভৌগোলিক কারণেই এক অঞ্চলের সাথে আরেক অঞ্চলের সম্পর্ক রক্ষা করা দুর্গম বলে একে অন্যের প্রতি প্রভাবও বিস্তার করতে যায় না। তাই তাদের গানে আসে প্রেম, রাজবন্দনা, ধর্মস্তুতি, প্রকৃতি, সৌন্দর্যচেতনা। কিন্তু ভাষা নিয়ে বা ভাষার অধিকার নিয়ে গান লেখা এটি অকল্পনীয় ব্যাপার। অথচ বাংলায় মধ্যযুগের কবি আবদুুল হাকিম সেই কবে লিখে গেছেন 'যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি'। তার মানে পুরোনো আমল থেকেই এ দেশে ভাষা নিয়ে হীনমন্যতা বা অন্যভাষাকে গৌরবের বস্তু মনে করার মানসিকতা কারও কারও মধ্যে প্রভাবিত ছিল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদের রক্ত বৃথা যেতে না দেওয়ার প্রত্যয় হয়তো বাঙালিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে গৌরবান্বিত করেছে। কিন্তু বাঙালির ভাষাকেন্দ্রিক সাহিত্য বা সংগীত রচনা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে। বাঙালি এমন এক জাতি তার ভাষার ঐক্য ছাড়া চেনা যায় না। আদি নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে এ ধরনের কোনো সংশয় কাজ করে না। চাকমা, লুসাই, মঙ্গোলয়েড, চিনের হান কিংবা ভারতের মণিপুরী প্রত্যেকের শারীরিক অবয়বে জাতি পরিচয় লুকিয়ে আছে। তাদের কর্ম, ধর্ম এবং সংস্কৃতির ভিন্নতা আলাদাভাবে চিনতেও সাহায্য করে। কিন্তু বাঙালির অস্তিত্ব তার ভাষার সাথে সম্পৃক্ত। একটি সমৃদ্ধ জনপদ হওয়া সত্ত্বেও আত্মভোলা ও ইতিহাস উন্নাসিক বলে পরিচিত এই জাতির আত্মপরিচয়ের জন্য তাই যুগে যুগে সচেতন যুগ-মনীষীগণ রচনা করেছেন ভাষাভিত্তিক সাহিত্য।
বাঙালির ভাষা অধিকার নিয়ে সচেতনতার আরেক কারণ ঔপনিবেশিকতা। এ দেশে হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি যেমন অস্ট্রিক, আর্য, মৌর্য, শৃঙ্গ, কলিঙ্গ, শক, হুন, মোগল, ব্রিটিশরা শাসন করতে এসে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। বাঙালি বারবার পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে। এই সংকটকে কাটিয়ে তোলার জন্য গান রচিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা গানের জনক রামনিধি গুপ্ত প্রায় দু শ বছর আগে লিখেছিলেন 'নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা'। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভাষাভিত্তিক গান রচনার প্রেক্ষাপট অনেক বেশি ঘোরতর ছিল। এই সময় পূর্বের সব চেতনাকে ছাপিয়ে নতুন একটি জাতিভিত্তিক পরিচয়ের অপচেষ্টায় বাঙালির আত্মগৌরব বিলীন হয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল। সে বাঙালি না মুসলমান? এই লঘু প্রশ্ন নিয়ে ঠোকাঠুকি শুরু হলো। ধর্মভিত্তিক জাতি বানাতে গিয়ে ভিন্ন একটি ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং হাজার হাজার বছর ধরে বহমান বাংলাভাষাকে একজন ব্যক্তির আঙুলের ইশারায় অন্তর থেকে মুছে ফেলার আদেশ বাঙালিকে বিস্মিত করেছিল। বিদেশি শাসকের হীন চক্রান্ত রুখে দেওয়ার জন্যে রচিত হয়েছিল অজস্র বাংলা গান। বিদেশিদের ভাষ্য ছিল 'বাঙালি জাতটাকে দাবিয়ে রাখতে হলে তাদের মাতৃভাষার কথা ভুলিয়ে দিতে হবে। তাহলেই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুত্ব মেনে নেবে।' এই মনোভাব বাঙালিকে বিস্মিত করেছিল, কিন্তু স্তব্ধ করেনি। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর রেসকোর্স ভাষণের রাতেই আনিসুল হকে তীব্র ঝাঁঝালো বাক্যে রচিত হলো প্রথম ভাষা-সংগ্রামের গান:
'ওরে ভাইরে ভাই
বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই...
শোনেন হুজুর—
বাঘের জাত এই বাঙালেরা
জান দিতে ডরায় না তারা
তাদের দাবি বাংলা ভাষা
আদায় করে নেবেই।'
১৯৫২ সালে এই বাক্যটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মধ্য দিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো সূর্যসন্তানেরা আত্মাহুতি দেওয়ার পর ভাষা সংগ্রামের গানে ভরে ওঠে বাংলা গানের ধারা। ২২ ফেব্রুয়ারি আবদুল গাফফার চৌধুরী রচনা করলেন কালোর্ত্তীণ কবিতা :
'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি।'
এই গানটি আবদুল লতিফের সুরে প্রথম সংগীত আকারে গীত হয় ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে। অন্যদিকে গাজিউল হক রচনা করেছিলেন প্রথম প্রভাত ফেরির গান :
'ভুলবো না ভুলবো না...
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
এই দাবিতে ধর্মঘট'
এ বছরই মোশাররফ উদ্দীন আহমেদ লিখেছিলেন :
'মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে,
আজিকে স্মরিও তারে।'
গ্রামীণ গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ একটি মর্মস্পর্শী গান লিখেছিলেন সেই সময়।
'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি,
তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।'
১৯৫৩ সালের পর বাংলাভাষা সংগ্রাম ও ভাষাপ্রেম নিয়ে কত গান রচিত হয়েছে, তা নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য মেলেনি। তবে বেশকিছু গান শিল্পগুণে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন গেড়েছে। যেমন আবদুল লতিফের 'ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়।' গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান। হাসান হাফিজুর রহমান রচনা করেছিলেন—'শহীদ মুখের স্তব্ধ ভাষা, আজ অযুত মনের বুকের আশা'।
কবিয়াল রমেশ শীল ১৯৫৪ সালে ঢাকায় বসে রচনা করেছিলেন—
'বাংলা ভাষায় হাসি কাঁদি স্বপন দেখি দিবানিশি
চিরদিন বাংলার আশা, বাংলাদেশে করি বাসা
বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলায় প্রত্যাশী।'
লোকমান ফকির লিখেছিলেন—
'একুশে আসে জানাতে বিশ্বে ভাষার কতটা মূল্য
ভাষার দাবিতে নেই কোনো জাতি বাঙালির সমতুল্য'
শহুরে শিক্ষিত রচয়িতার পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জের অসংখ্য বাউল, কবিয়াল, জারিয়াল, বয়াতি, কীর্তনীয়া, বিচারগায়ক, গম্ভীরা গায়কদের মধ্যে থেকেও বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য গান। বিশেষ করে পাঞ্জুসাঁই, মোকসেদ আলী সাঁই, নিবারণ পণ্ডিত, ফণী বড়ুয়া, মোসলেম উদ্দিন, শফি বাঙালি, জসীমউদ্দীন প্রমুখের বেশ কিছু ভাষার গান স্মরণীয় হয়ে আছে। বাউল মহিন শাহ রচনা করেছিলেন 'কি যাদু বাঙলা গানে/ আ-মরি মরি/ ছন্দরসে মধুমাখা/ মন নিল রে হরি।' কিংবা 'মিষ্টি আমার মায়ের ভাষা/ শিখিয়াছি মার কোলে বসি/ কেমন মধুর কেমন খাসা'। বিচারশিল্পী আবদুল হালিম বয়াতি গান বেঁধেছিলেন 'ভাষা-আন্দোলনের জারি' ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ৫২ হয়ে পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলির ইতিহাস দীর্ঘ এই গানের মধ্যে উঠে এসেছে। একটি স্তবকে আছে :
'একুশে ফেব্রুয়ারি সুপ্রভাতের কালে
জীবন-মরণ খেলা আজ বাঙালির কপালে।
বিশে ফেব্রুয়ারি রাত্রে থমথমে ভাব
কারো চোখে ঘুম নাই একুশে খোয়াব।
আহাম্মদ রফিক বলেন কী হবে উপায়
সরকারের চুয়াল্লিশ ধারা নিষেধাজ্ঞা রয়।
আবার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের মতে
আপোসবাদী নীতি যারা চাইয়াছিল চালাতে'
সিলেটের গণকবি শাহ আবদুল করিম লিখেছেন 'ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে/ সালাম বরকতের বুকে/ গুলি চালায় বেঈমানে/ বাঙালির বাংলা ভাষা এই যে তাদের মূল ভরসা/ এই আশায় বঞ্চিত হলে কি চলে' অথবা 'সালাম আমার শহীদ স্মরণে/ দেশের দাবী নিয়ে দেশপ্রেমে মজিয়া/ প্রাণ দিলেন যে সব বীর সন্তানে/ জন্ম নিলে পরে সবাইতো মরে/ স্বাভাবিক মরা এই ভুবনে/ দেশের জন্য প্রাণ যারা করে দান/ স্মরণ করি আজ ব্যথিত মনে।'
বাংলাভাষা রক্ষায় বাংলাদেশই যে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ, তার প্রমাণ উপরের গানের চরণে লক্ষণীয়। কিন্তু ভাষার সমৃদ্ধির কথা বলতে হলে সেই ভাষাকে যথার্থ অর্থে চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও গবেষণা এইদিকটিতে অনেক বেশি অগ্রসর। মানুষের জীবন ও মননশীলতার বাস্তববোধ এবং উচ্চশিক্ষায় ভাষাকে যথার্থ ব্যবহার করতে পারার মধ্যেই ভাষার মর্যাদা ও প্রভাব রক্ষা পায়। সেই দিক বিচারে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই অবশ্য, কিন্তু বিশ্বপরিবারে ভাষার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য যেসব তাত্পর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের সাথে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বিষয়ের সমন্বয় করা হয়, বাংলা ভাষাকে নিয়ে সেইসব পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। ইন্টারেটে এখনও পরিশীলিত উপায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয়নি। তাই বলা যায় এখনও সংগ্রাম থামেনি। এতদিন যে ভাষা রক্ষার জন্য লড়তে হয়েছে বাঙালিকে, এখন তা সমৃদ্ধি দানের জন্য লড়তে হবে। পরিশেষে পশ্চিমবঙ্গে খ্যাতিমান গণশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের অংশ দিয়ে শেষ করা যাক :
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিত্কার
বাংলা আমার দৃপ্ত শ্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক
আমি একবার দেখি বার বার দেখি দেখি বাংলার মুখ