আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ২০১৩, শহীদ দিবস। ছয় দশক আগে এমনই এক ২১ ফেব্রুয়ারি, এমনই এক বৃহস্পতিবার ভোরে দুইজন মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র ফুলার রোডে দাঁড়ানো। গোটা এলাকা শান্ত—রিকশা, ঘোড়া গাড়ি কিছুই নেই। স্তব্ধ সকাল। দুজনেরই ভাবনা:একুশের হরতাল তাহলে ঠিকঠাক মতই হচ্ছে। হঠাত্ একটা গাড়ির আওয়াজ। ওরা ফিরে তাকাতেই দেখা গেল কুখ্যাত দৈনিক পত্রিকা 'মনিং নিউজ' এর 'ভয়েস অব নেশন' লেখা ছোট অস্টিন গাড়িটা একটু বাঁক নিয়ে দ্রুত শাঁ করে বেরিয়ে গেল। বোধ হয়—আমাদের দেখে। গাড়িটার পেছন পেছন ছুটলেন আজমল—আজকাল যেমন মাঝেমধ্যে টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়। ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তার স্বগতোক্তি:'ধরা গেল না'। এমনই ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, বাম রাজনীতিতে প্রবলভাবে আসক্ত শাহজাদপুরের আলী আজমল। দুইজনে হেস্টেলে ফিরে আসি। ভোরের মিঠে রোদ গায়ে মেখেও আমতলার ছাত্র সভা নিয়ে চিন্তাটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।
হেস্টেল প্রাঙ্গণে দু'চারজন করে ছাত্র জড়ো হতে শুরু করেছে। কাছাকাছি নবকুমার ইন্সটিটিউশন থেকে নবম-দশম শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র এবং ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কুল থেকেও কয়েকজন এসেছে। রাজনীতিমনস্ক মেডিক্যাল ছাত্ররাও তৈরি হচ্ছে আমতলার ছাত্র সভায় যোগ দেবার জন্য। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিষয়ে। আসলে সিদ্ধান্ত তো আগেই নেওয়া হয়ে গেছে—যে কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভেঙে একুশের কর্মসূচি পালন করতে হবে। আমতলার সভায় ওটা জায়েজ করে নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে নানা বয়সী ছাত্র-ছাত্রীর জমায়েত। আপসবাদীদের সঙ্গে বিপরীত চিন্তার ছাত্রনেতাদের তর্ক-বিতর্ক, উত্তেজনা-উত্তাপ। সর্বদলীয় পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক সাহেবের আপোসবাদী যুক্তি পরামর্শ গ্রহণ করেনি উপস্থিত ছাত্র জামায়েত। সিদ্ধান্ত ১৪৪ ধারা ভাঙার। আর সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মুখে রাস্তায় দাঁড়ানো পুলিশবাহিনীর টিয়ারগ্যাস বর্ষণ এবং রাস্তায় বেরোতেই লাঠিপেটা ছাত্রদের অস্থির করে তোলে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে পূর্বোক্ত ছাত্র বন্ধু আলী আজমল, ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক খান ও হাবিবুর রহমান শেলী ট্রাকে দাঁড়ানো। কিন্তু এক সঙ্গে অনেক ছাত্র বেরিয়ে আসায় সামাল দিতে পারেনি পুলিশ। অনেকে অনাহত এগিয়ে যেতে পেরেছে।
ছাত্ররা নানাদলে বিভক্ত হয়ে গন্তব্যস্থল মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছে গেছে। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারার মৃত্যু হলো। হোস্টেল প্রাঙ্গণে জমায়েত ক্রমে বাড়ছে। বেশ কিছু অছাত্র, নানান পেশার মানুষ এসে যোগ দিয়েছেন মেডিক্যাল ব্যারাক প্রাঙ্গণের জমায়েতে। পুলিশও তাদের স্থান পরিবর্তন করে হোস্টেলের সামনের রাস্তায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তুলেছে। বেলা ৩টায় পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার অধিবেশন। তাই নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা পাকা করে তুলতে ব্যস্ত পুলিশ। তাদের বড়কর্তা অনেকে হাজির। সেসময় প্রাঙ্গণের ছবিটা ছিল খুবই নৈরাজ্যিক। ছাত্র-জনতা পরিষদ ভবনে যাবার চেষ্টা করছে। নেতাদের কাউকে তখন দেখা যায়নি। ছাত্ররা যে যার মতো করে তত্পর। এর মধ্যে বেলা তিনটা বেজে গেছে। পরিষদ ভবনে অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। পরিষদ সদস্যদের কেউ কেউ যাবার পথে বেশ আতংকে আছে। জমায়েতে স্লোগান চলছে: 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' 'পুলিশি জুলুম চলবে না' ইত্যাদি। হোস্টেল কন্ট্রোলরুম থেকে মাইকে প্রচার চলছে। পুলিশের টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ, কোনো কিছুতে ছাত্রদের প্রতিবাদ বন্ধ হয়নি।
সশস্ত্র পুলিশ বনাম নিরস্ত্র ছাত্রদের দ্বন্দ্বের ছবিটাকে পূর্ণতা দিতেই হয়তো জমায়েতস্থলে উপস্থিত বড় কর্তাদের গুলি চালিয়ে ঠাণ্ডা করার সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের পরিণাম সরকারের পক্ষে যায়নি। নুরুল আমিন সরকারকে এ হঠকারিতার খেসারত দিতে হয়েছে দু'বছর পর সাধারণ নির্বাচনে। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ রাজনীতির বিনাশ। উদ্ভব বিপরীতধর্মী রাজনীতির। মুসলিম লীগকে বিদায় নিতে হয়েছে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। এর মূল কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে চার ছাত্র-অছাত্রসহ অন্তত ছয়জনের মৃত্যু। ওরা শহীদ। রফিক, জব্বার, বরকত এবং পরে সালাম। রাস্তায় অচেনা দুজন। গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় এবং কন্ট্রোল রুমের প্রচারে পুরনো ঢাকা হোস্টেল প্রাঙ্গণে ভেঙ্গে পড়ে। ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়া তাদের ক্ষুব্ধ ও সরকার বিরোধী করে তোলে। শুধু শহর ঢাকা নয়, গোটা প্রদেশে রক্তাক্ত একুশে ছাত্র-জনতাকে প্রতিবাদে শক্তিমান করে তোলে।
আরো করে ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনা জওয়ানদের গুলিতে আরো ছয়জনের মতো মানুষের মৃত্যুর কারণে। পুলিশের গুলিবর্ষণ একুশেকে চিরায়ত অবস্থানে নিয়ে যায়। একুশের আন্দোলন জাতিকে শক্তির উত্স হিসাবে দুটি প্রতীক উপহার দিয়েছিল। একটি হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, অন্যটি শহীদ মিনার। এ দুই মিলে বাঙালি জাতির জন্য সংগ্রামের উত্স তৈরি করে। শহীদ মিনারও তৈরি হয়েছিল গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায়। ২২ ফেব্রুয়ারি রাজপথে নয়া স্লোগান 'শহীদ স্মৃতি অমর হোক'। আর শহীদ স্মৃতি অমর করে তুলতেই মেডিক্যাল হোস্টেলের ছাত্ররা একরাত্রির শ্রমে তৈরি করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, সেসব দুদিন পরের কথা। ২১শে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড শুধু পরিষদ অধিবেশনেই ভাঙ্গন ধরায় না, ভাঙ্গন ধরায় পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের মনে। তারা দলে দলে ছুটে আসেন হোস্টেল প্রাঙ্গণে। একুশেকে একুশে করে তুলতে। সূর্য বিস্ফোরণের দিন এভাবে গণজাগরণের সূচনা ঘটায় যা দেখা যাবে পরদিন শুক্রবারের তত্পরতায়। আপাতত এই বৃহস্পতিবার কালবেলার মতো দিনটি ছিল অভাবিত, সবার চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে, এমনটা কারো ধারণায় ছিল না। এটা সম্ভব করে তোলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাজনীতিমনস্ক সাধারণ ছাত্রসমাজ।
লেখক:ভাষাসংগ্রামী ও প্রাবন্ধিক