যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা শিশুদের মানসিক চাপ সম্পর্কে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াছেন। প্রতিবেদনটি ছাপা হইয়াছে এপেটাইট সাময়িকীতে। তাহাতে দেখা যায়, শিশুর উপর মানসিক চাপ তাহার মোটা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। আর এই স্থূলতা তাহার অন্যান্য অনেক রোগের উপসর্গ হইয়া দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দিষ্ট শিশুকে বক্তৃতা দিতে ও অঙ্ক কষিতে বলেন। ইহার ফলে তাহাদের মধ্যে কতটা মানসিক চাপ পড়ে তাহা পরীক্ষার জন্য তাহাদের লালায় নিসৃত কোর্টিসল নামের হরমোনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। কাজগুলি করিতে দেওয়ার আগে ও পরে এই পরীক্ষা চলে। পরে দুপুরে খাওয়ার পরপরই শিশুদের আবার হালকা খাবার দেওয়া হয়। তাহাতে দেখা যায়, যে সব শিশু মানসিক চাপে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাইয়াছে, তাহাদের লালায় কোর্টিসলের পরিমাণ বেশি। আর ক্ষুধা না থাকিলেও তাহারা অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি খায়। এই বাড়তি ক্যালরির কারণে তাহাদের মেদ বৃদ্ধি পায়।
শুধু শিশু-কিশোর নহে, সকল বয়সী মানুষের জন্য মানসিক চাপ ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ইহা জীবনকে অনেক সময় বিপন্ন করিয়া তোলে। আধুনিক জীবন-যাপন যেমন মানুষের চলার পথকে মসৃণ ও সুখময় করিয়াছে, তেমনি অধিক মাত্রায় যান্ত্রিকতার কারণে মানসিক চাপও বৃদ্ধি করিয়াছে। এখন দেখা প্রয়োজন আমাদের শিশুদের মানসিক চাপ কিসে কিসে বাড়ে। ইহার একটি বড় কারণ এই যে, শিশুকালে লেখাপড়ার চাপ বৃদ্ধি পাওয়া। ইহা হইতে অনেকের মধ্যে স্কুলভীতিও কাজ করে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা যথাসম্ভব আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়া দরকার। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ স্কুলে শিশুদের ৮-১০টি বই পড়িতে বাধ্য করা হয়। অথচ প্রথম শ্রেণীতে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের সংখ্যা মাত্র তিনটি। যদি শিশু বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদগণ অধিক বই পড়ার সুপারিশ করেন, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু এমন সব লেখকের দেশি-বিদেশি বই পড়ানো হয় যাহা শিশুরা আত্মস্থ করিতে পারিবে কিনা সে ব্যাপারে কোন গবেষণা হয় না। আবার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা আসলে কত বত্সর হইবে সে ব্যাপারেও নির্দিষ্ট দিকনির্দেশানা নাই। প্লে, নার্সারি, কেজি ওয়ান ও কেজি টু'র ব্যাপক প্রচলন তো আছেই, এমনকি দুই বত্সরের দুধের শিশুর জন্য এই রাজধানী ঢাকার কোন কোন অভিজাত এলাকায় আছে 'বাটারফ্লাই'। প্রাতিষ্ঠানিক বাড়াবাড়ির জন্য আমেরিকার মত দেশে হোমস্কুল চালু হইয়াছে এবং দিন দিন তাহার জনপ্রিয়তা বাড়িতেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষাবোর্ডের নিবন্ধন নিয়া বাবা-মা বা হাউজ টিউটরের সাহায্যে লেখাপড়া চালাইয়া যাইতেছে বহু শিশু-কিশোর। শুধু বত্সর শেষে বা নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়া পরীক্ষা দিতেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে এই বাংলাদেশেও এরকম হোম স্কুলের সুযোগ থাকা দরকার, যাহাতে শিশুরা সুস্থভাবে তথা মানসিক চাপ না নিয়াই বড় হইতে পারে।
অন্যদিকে শহরের শিশুরা একরকম বন্দী জীবন যাপন করে। ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস ও সংকীর্ণ স্কুল ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার কারণে তাহারা ঠিকমত খেলাধুলা করিতে পারে না। তাহাদের সঠিকভাবে সামাজিকরণ হয় না। মূলত বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে এখানে অপরিকল্পিত নগরায়নই সার হইতেছে। ফলে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত মাঠ-ঘাট, প্রান্তর ও পার্ক ইত্যাদি কমিয়া যাইতেছে। ফলে বেশিরভাগ সময় শিশুরা ঘরে বসিয়া ও টিভি দেখিয়া সময় কাটাইতেছে। এই পরিস্থিতি তাহাদের মানসিক অবসাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এখন আমেরিকার উক্ত গবেষণা হইতে বোঝা যাইতেছে শুধু ফাস্টফুড নহে, ইহাও তাহাদের স্থ্থূলতার জন্য দায়ী। সুতরাং শিশুদের মানসিক বিকাশের যতগুলি অন্তরায় রহিয়াছে, আগামী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যথাসম্ভব তাহা দূর করিতে আমাদের সচেষ্ট হইতে হইবে।