উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার পর কেটে গেছে সাড়ে তিন বছর। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে এখন পর্যন্ত লাইব্রেরিসহ ভাষা জাদুঘর নির্মিত হয়নি। কবে এই জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে, তাও বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যদিও রায় বাস্তবায়ন না করায় সরকারকে আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে শুধু জাদুঘরই নির্মাণ নয়, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস (সংক্ষিপ্ত তথ্যাবলী) সন্নিবেশিত করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ব্রুশিয়ার প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা উক্ত ব্রুশিয়ার থেকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন। ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে এ রায় দেন। রায়ে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে জাদুঘর নির্মাণের জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ে যা আছে :শহীদ মিনার সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র অবহেলা করতে পারে না। তাই, আদালত মনে করে শহীদ মিনার সংরক্ষণের জন্য সরকারের ওপর নির্দেশনা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদ বাঙালি জাতির ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ওপর ন্যস্ত করলেও এ সম্বন্ধে কোনো পদক্ষেপ এযাবত্কালে কোনো সরকার গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। শুধু ভাষা জাদুঘর নির্মাণই নয়, হাইকোর্টের রায়ে ভাষাসৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরি, ভাষাশহীদদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তসহ ছবি সম্বলিত বোর্ড/ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে মূল বেদিতে কোনো রকমের মিটিং, মিছিল, পদচারণা, আমরণ ধর্মঘট করা থেকে বিরত রাখতে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে আরো বলা হয়, শহীদ মিনার সংগ্রামের প্রতীক, শহীদ মিনার সৃষ্টির প্রতীক। শহীদ মিনার পুরোনো রাষ্ট্র সমাজ ভেঙে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার প্রতীক। শহীদ মিনার অন্যায় শাসন ও শোষণ অবসানের সংগ্রামের প্রতীক, শহীদ মিনার আর্থ-সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক। শহীদ মিনার মানুষের মিনার, শহীদ মিনার সকল মানুষের জন্য উম্মুক্ত। জাতি, ধর্ম, সমপ্রদায়, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে মানুষের মিলনতীর্থ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। শহীদ মিনারে সকলকে আসতে হয়, কিন্তু কেন? কারণ, শহীদ মিনার মানুষের ভেদাভেদ ভোলায়, শহীদ মিনার মানুষকে মেলায়। শহীদ মিনার সব জাতির মাতৃভাষার প্রতীক।
ভাষাসৈনিকদের স্মরণে স্থাপিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা সংরক্ষণ করবার উদ্দেশ্যে জনস্বার্থে মানবাধিকার সংগঠন 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ' হাইকোর্টে ২০১০ সালে রিট আবেদন দায়ের করে। ওই আবেদনের ওপর রুল জারি করে আদালত। রুল শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দারের ডিভিশন বেঞ্চ ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, শহীদ মিনার সম্পর্কিত রিট মামলাটি একটি সাধারণ মামলা নয়। এটা কোনো নির্দিষ্ট দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিশেষ তর্কিত আদেশ নিয়ে মামলা নয়। এটা একটি জনস্বার্থমূলক মামলা। এতে রিট আবেদনকারীর কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত নেই। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক 'শহীদ মিনার' সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যেই আবেদনকারীর এই প্রচেষ্টা।
রায়ের ০৮টি নির্দেশনা : রায়ের ৮ দফা নির্দেশনাসূমহ হচ্ছে, ১. ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, এর ভাবগাম্ভীর্য মর্যাদা রক্ষা করা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-এর নির্ধারিত এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং উক্ত এলাকায় যাতে কোনো ভবঘুরে ঘোরাফেরা বা অবস্থান গ্রহণ ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালাতে না পারে। ২. মূল বেদিতে কোনো রকমের মিটিং, মিছিল, পদচারণা, আমরণ ধমর্ংঘট করা থেকে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তবে মূল বেদিতে ফেব্রুয়ারি মাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলতে এবং শহীদ মিনারের মূল বেদি ভাষাসৈনিকসহ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের মরদেহ সর্বস্তরের জনগণের সম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার, বিশেষ দিনে ফুল দিতে এবং মূল বেদির পাদদেশে সকল প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি চলতে কোনো রকম বাধা নিষেধ থাকবে না। শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার্থে কমপক্ষে ৩ জন নিরাপত্তাকর্মী পূর্ত মন্ত্রণালয়কে নিয়োগ এবং ৩ জন পরিছন্নকর্মী নিয়োগ দেয়ার জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হলো। ৩. ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সকলকে মরণোত্তর জাতীয় পদক প্রদান এবং জীবিতদের জাতীয় পদক প্রদানে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) নির্দেশ প্রদান করা হলো। এবং ভাষা শহীদদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত ও ছবিসম্বলিত বোর্ড/ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করতে হবে। ৪. যে সকল ভাষা সৈনিক জীবিত আছেন তাঁদের মধ্য থেকে যদি কেউ সরকারের নিকট আবেদন করেন, তাহলে তাঁদেরকে যথাযথ আর্থিক সাহায়তা এবং চিকিত্সার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫. সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ১টি এবং জেলায় জেলায় ডিসির মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত তালিকা যাচাই বাছাইপূর্বক ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে হবে, কমিটির সদস্য হবেন ভাষা সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা। ৬. কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ ভাষা জাদুঘর নির্মাণ করতে হবে। পূর্ত মন্ত্রণালয় জাদুঘরের নির্মাণ কাজ ওই সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। ৭. ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জীবিত ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা এবং সরকারের সাধ্যমতো সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। ৮. বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) শহীদ মিনার তৈরি এবং সংরক্ষণ করতে হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তলব : এই রায় বাস্তবায়ন না করার অভিযোগে গণপূর্ত ও সংস্কৃতি সচিবের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালত অবমাননার মামলা করে 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ'। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সংস্কৃতি সচিবকে তলব করে। পরে সচিব আদালতে হাজির হয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রায় অনুযায়ী ভাষা শহীদদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া শহীদ মিনারের মূল বেদিতে কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করা যাবে না উল্লেখ করে একটি সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরই আদালত সচিবকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়। একইসঙ্গে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ভাষা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ত সচিবকে সময় বেঁধে দেন।
রায় বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী ইকবাল কবির ভূইয়া ইত্তেফাককে বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ভাষা জাদুঘর নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ভাষা জাদুঘরের নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে, তবে এখনো শেষ হয়নি।
রিটকারীর কৌঁসুলি এডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, রায় বাস্তবায়ন না করায় সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আদালত অবমাননার অভিযোগ করেছিলাম। পরে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়াসহ কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলে পূর্ত সচিবকে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত। দুঃখজনক হলেও সত্য, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ভাষা জাদুঘর স্থাপনসহ কিছু নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।