শুরুটা ১৯৫২ সালে। এ বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায় মাতৃভাষা বাংলার জন্য ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ এবং রক্তদানের মাধ্যমে ইতিহাসের শুরু। এরপর কেটে গেছে ষাট বছরেরও বেশি। দীর্ঘ এ সময়ে রাষ্ট্রভাষা শুধু বাংলা হয়নি, পূর্ব-পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিও আমাদের হয়ে গেছে। অর্জনের এসব গল্পের পেছনে আছে দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস। কোনো অর্জনই সহজে মেলে না। তার জন্য আন্দোলন চাই, সংগ্রাম চাই, চাই রক্ত! বাংলাকে এদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনেও ছিল তেমন অনেক রক্তক্ষরণের গল্প। ভাষার লড়াইয়ে সবচাইতে বড় আত্মত্যাগের ইতিহাসটি আমরাই রচনা করেছি। তবে ভাষা আন্দোলন কেবল একটা জাতীয়তাবাদী আবেগের ফসল কিংবা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আন্দোলন নয়, বরং এর গভীরে ছিল আরো অনেক কিছু। ছিল রাজনীতি, ছিল সংস্কৃতি, ছিল অর্থনীতি।
ভাষার পরিধি মহাসাগরের মতো। এই মহাসাগরের জলরাশির সৃষ্টি সেই চর্যাপদের কাল থেকে। নদীর স্রোতের মতো এ ধারা সদা বহমান। সে ধারা থেকে যদি শুধু ভাষা আন্দোলনকে আলাদা করা হয় তাহলেও দেখব—সংগ্রামের সে প্রেরণা থেকেও উত্সারিত হয়েছে অজস্র রচনা। ২০০২ সালে আমাদের মহান সে ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ উপলব্ধি করেই ২০০৮ সালে অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে বাংলা ভাষা স্মারক 'মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ'। আমাদের চোখটাই যখন ব্যবসার দিকে তখন সে ব্যবসার কথাটি না ভেবে বিপুল কলেবরে ব্যয়সাপেক্ষ ভাষার এমন একটি সংকলন প্রকাশের জন্য অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতেই পারে!
বইটিতে সংকলিত হয়েছে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, আন্দোলনের পটভূমি, সংগ্রামীর সাক্ষাত্কার, ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র, আন্দোলনের স্মৃতিকথা, ভাষা সৈনিকের জীবনী, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবিতা। আরো আছে ভাষার বিবর্তন, ভাষা বিতর্ক, বিদেশে বাংলা চর্চা, বাংলা চর্চা ও ব্যবহার, একুশের সংকলন কিংবা বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্, ভাষা সংস্কার, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার সমস্যাসহ এমন প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয়। কয়টা বলব! যেন বিন্দুতে সিন্ধু! লেখকতালিকাটাও বেশ চমকপ্রদ। কার লেখা নেই এতে? মধ্যযুগের শাহ মুহাম্মদ সগীর, আবদুল হাকিম, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী থেকে শুরু করে একালের আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল পর্যন্ত। লিখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল। আরো আছে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, দীনেশ চন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসুসহ অসংখ্য গুণী লেখক। বলা বাহুল্য, সব লেখাই ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার নানা বিষয়কেন্দ্রিক।
ভাষা সংগ্রামের ষাট বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলা ভাষা আজও তার আপন ঠিকানা পায়নি, মেলেনি সঠিক মর্যাদা। এখনো হাইকোর্ট থেকে রুল জারি করতে হয় সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস ইংরেজিতে, কোর্ট-কাচারিতে আজও ইংরেজিতে রায় লেখা হয়। বাংলা ভূ-খণ্ডের সর্বত্র ভিন্ন ভাষার জয়জয়কার। আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি জাদুতে আসক্ত আমাদের উঠতি সমাজ। ভাবখানা এমন, যেন বাংলা গাঁও-গেরামের ভাষা, অশিক্ষিতের ভাষা! বাংলাকে অবজ্ঞা করার পায়তারা আজও অনেকের সহজাত বাসনা। তবুও বলি, স্ফুলিঙ্গ যতই প্রবল হোক শীর্ণ দিপাবলি তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পেছনে অনেক আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কার্যকারণও সক্রিয় ছিল। এসবও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অংশ। একে বাদ দিয়ে আমাদের ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকে। আর তাই সন্নিবেশিত হয়েছে 'ভাষা আন্দোলনে রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতি' পর্বটি।
সাক্ষাত্কারে অনেক কথাই খোলাখুলি বলা যায়। অনেক না বলা কথাই উঠে আসে সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে। সে বিষয়টি বিবেচনা করে সংকলনটিতে ভাষাসৈনিকদের বেশকিছু সাক্ষাত্কার সংকলিত হয়েছে। রয়েছে আবদুল মতিন, মোহাম্মদ সুলতান, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, আতাউর রহমান খান, বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক গোলাম আযম, ড. সুফিয়া আহমদ, আহমদ রফিকসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষাসৈনিকের সাক্ষাত্কার।
তবে ইতিহাস শুধু স্মৃতিনির্ভর নয়, সাক্ষাত্কার ভিত্তিক নয়, এর থাকে অনেক লিখিত প্রামাণ্য দলিলও। কখনো সেটা সঙ্গে-সঙ্গেই প্রকাশিত হয়, কখনো বা বহু যুগ পরে প্রকাশিত হয়ে এতদিনের প্রচলিত ইতিহাসকেই পাল্টে দেয়। একুশের আগে-পরের অনেক লিখিত দলিল সন্নিবেশিত হয়েছে সংকলনটিতে। যার মধ্যে রয়েছে জিন্নাহর সেই বহুকথিত ও বিতর্কিত ভাষণ, তত্কালীন সংসদীয় কার্যবিবরণী, তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট, দেশের বিভিন্ন স্থানে একুশের ঘটনার প্রতিক্রিয়া, তত্কালীন সংবাদপত্রের কাটিং। তবে এ পর্বে সবচেয়ে বড় আকর্ষণটি বোধহয় তাজউদ্দিন আহমদের স্বহস্তে লিখিত ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির ডায়রির কাটিং!
ভাষা আন্দোলনের বাইরে বাংলা ভাষা, ভাষাকেন্দ্রিক অনেক সমস্যা-সম্ভাবনা এবং বির্তককে এতে স্থান দেওয়া হয়েছে। রয়েছে ভাষার বিবর্তন, মুদ্রণশিল্প, ভাষা বিতর্ক, ভাষা সংস্কার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা সমস্যাসহ অসংখ্য বিষয়। যে বিষয়গুলো বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
গৌরবের ভাষা আন্দোলন অতিক্রম করেছে আরেক গৌরবের সুবর্ণজয়ন্তী। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এতদিন বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন অনেক কাজই হয়েছে। সেগুলো সংকলিত করার প্রয়াসও চালিয়েছেন কেউ কেউ কিংবা কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এমন বৃহত্ কলেবরে এবং এমন পরিকল্পনা মাফিক কাজ একটিও হয়নি। আর তাই সংকলনটি হাতে থাকলে তথ্যের প্রয়োজনে এ-বই থেকে সে-বই ছোটাছুটির অস্থিরতা থেকে বিজ্ঞ পাঠক হয়তো রক্ষা পাবে। আরো একটি কথা, শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, এর সাথে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ভাষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় সন্নিবেশিত হওয়ায় সংকলনটির মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে নিঃসন্দেহে।
তবে ফুলেও কাঁটা থাকে। প্রায় ১,৮০০ পৃষ্ঠার বইটি শেষ পর্যন্ত যে অবয়ব পেয়েছে তাতে তাকে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি বেশ কষ্টসাধ্য বলেই মনে হয়। বিশেষ করে বইটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য থেকে পাঠক বঞ্চিত হবে বলে আশঙ্কা। অবশেষে দরকারি কাজটা শেষ হলো বটে, কিন্তু আত্মপ্রসাদের কোনো অবকাশ রইল না। বরং, আকাঙ্ক্ষিত সৌকর্যসাধন শেষ হলো না বলে অতৃপ্ত মনে খেদ রয়ে গেল। পরবর্তী কোনো সংস্করণে বইটির সে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে— প্রকাশকের কাছে এমন নিবেদন তোলা থাকল!
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, 'উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।' আপনিও কি তাই মনে করেন?