মিউজিকের প্রতি সব প্রজন্মেরই তুমুল ভালোবাসা থাকে। এদেশের বিনোদনের বিশাল তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে ডিজে শিল্পীদের নাম। বিভিন্ন কনসার্ট, অনুষ্ঠান এমনকি ঘরোয়া আয়োজনে মাতিয়ে রাখেন একজন ডিজে। বিভিন্ন গান মিশিয়ে বা 'মিক্সিং' করে থাকেন ডিস্ক জকি বা ডিজেরা। নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন এই ক্রেজটিকে পেশা হিসেবে নিতে রয়েছে দারুণ আগ্রহ। কারণ এ সময়ের ডিজেরা দেশ এবং দেশের বাইরেও সমান তালে কাজ করছেন। এ প্রজন্মের তেমনই কয়েকজন ডিজে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন। গ্রন্থনা করেছেন রিয়াদ খন্দকার ও সাজেদুল ইসলাম শুভ্র
মো. হামিদ প্রিন্স
সময়ের সাথে সাথে বিনোদনের ধারা পরিবর্তন হয়েছে। এই ধারারই নতুন সংযোজন ডিস্ক জকি। বিনোদনের এই নতুন মাধ্যমটিতে যাদের উল্লেখ্যযোগ্য অবদান ছিল তাদের অন্যতম হচ্ছেন মো. হামিদ প্রিন্স। সকলের কাছে যিনি ডিজে প্রিন্স নামেই ব্যাপক জনপ্রিয়। নতুনত্বের কৌতুহলে ও শখে এই মাধ্যমে কাজ শুরু করলেও একসময় এটিকেই পুরোদমে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার সৃষ্টিশীলতা নতুন প্রজন্মকে গানের ভিন্নরকম স্বাদ দিয়েছে। শুধু দেশে নয় বিদেশের মাটিতে তিনি সফল একজন সফল ডিজে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০০'রও বেশি শো তিনি করেছেন দেশের বাইরে। ছোটবেলায় বিভিন্ন কারণে তাকে দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন শো দেখে তার এই বিষয়ে ঝোঁক তৈরি হয়। আর গানের প্রতি ভালোলাগা ছিল সবসময়ই। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি গান বাজানো শুরু করলেন বিভিন্ন শোতে। তখন আমাদের দেশে ডিজে পেশাটা অনেকেরই কাছে অচেনা। মো. হামিদ প্রিন্স নিজের আইকন হিসেবে মানেন হার্ড ওয়েলকে। ডিজে পেশাটির প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের স্বরূপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'ডিজে একটি শৈল্পিক কাজ। প্রতিটি জিনিসের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে, এক্ষেত্রে ব্যক্তির উপরই নির্ভর করে সে কোনটিকে গ্রহণ করবে। তবে এই কথাটি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, আমার সাথে নতুন প্রজন্মের যারা মিউজিক তৈরির কাজ করছেন, তারা অনেক ভালো কাজ করছেন। আমার মানুষকে সুস্থ বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে আমরা ভালো সাড়াও পাচ্ছি। তাদের আগ্রহের কারণেই আমরা একটি স্কুলও গড়েছি। সেখানে প্রচুর ছাত্রছাত্রী প্রতিনিয়ত আসছে বিষয়টি শেখার জন্য।' তিনি আরও জানালেন, নতুন প্রজন্মের ডিজেদের কাজ আসলেই আশাজাগানিয়া। একই সাথে এই পেশার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহী এ পেশার সম্ভাবনাকেই প্রমাণ করে। তাদের এ আন্তরিকতা বাহবা দেওয়ার মতো। কিন্তু তাদের একটি নেতিবাচক দিকও আছে, তারা খুব অল্প সময়ে সবকিছু পেতে চায়। যা আসলেই কখনও সম্ভব নয়। নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'যেকোনো কাজে অল্প সময়ের মধ্যে হতাশ হয়ে পড়া যাবে না।' তার মতে, এই পেশাটা অনেক কষ্টের, শুধু গ্রামার শিখে এলে এই পেশায় ভালো করা যায় না। প্রিন্স আরও জানালেন, এই পেশায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে। তাই শেখার গুরুত্বটা এই পেশায় অনেক বেশি। পরিশ্রমই সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয়। আর ডিজেদের সাফল্যের হিসাব পাওয়া যায় শ্রোতাদের মতামত থেকেই।
মো. হামিদ প্রিন্স
ডাকনাম :প্রিন্স
জন্ম তারিখ ও স্থান :৭ জুলাই, ঢাকা
মায়ের নাম :আয়েশা আকতার
বাবার নাম :মৃত মো. আব্দুর রাজ্জাক
প্রথম স্কুল :সানফ্লাওয়ার, ধানমন্ডি
প্রিয় মানুষ :আমার বোন
প্রিয় উক্তি :যেখানে গান নেই, সেখানে জীবন নেই।
প্রিয় পোশাক :ওয়েস্টার্ন
অবসর কাটে যেভাবে :গান শুনে
সাফল্যের সংজ্ঞা :কঠোর পরিশ্রম
০০০
মারজিয়া কবীর সনিকা
দুই কানে লাগানো হেডফোন। বাজছে গানের সুর। চোখের তারা খেলা করছে হাতের সামনে রাখা ডিস্ক প্লেয়ার দুটোতে। আঙুলের নিয়ন্ত্রণে চলছে বহুমাত্রিক শব্দের খেলা। স্পিকার থেকে ভেসে আসছে বুককাঁপানো সুর। প্রিয় ডিস্ক জকির (ডিজে) বাজনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে নাচছে সবাই। আর কে না চায় এমন এক উত্সবের মধ্যমণি হয়ে থাকতে। এই প্রজন্মের কাছে ডিজে সনিকা দারুণ এক ক্রেজ। দর্শক-শ্রোতা মাতাতে তার জুড়ি মেলা ভার। ২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিয়মিত হতে থাকেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি নারী ডিজে হিসেবে সনিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০০৭ সালে। সনিকা বলেন, 'ডিজে রাহাতের স্কুল 'গ্যারেজ' থেকে যাত্রা শুরু করি। এরপর ডিজে বিষয়ে ভারত ও থাইল্যান্ডে শিখেছি। ভালো লাগে তখন, যখন একটা নতুন গান নিজের মেধা দিয়ে বাজাই আর অন্যরা আনন্দ পায়।' আর বর্তমানে ডিজের চাহিদার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ডিজে ধারণাটি মোটামুটি আশির দশক থেকে বিকশিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা।' বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে যেকোনো বিশেষ দিবস, কর্পোরেট পার্টি, জন্মদিনের অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের অনুষ্ঠান—কোনোখানেই বাদ যায় না ডিজে। ডিজে হতে আগ্রহীদের জন্য সনিকা বলেন, 'যেহেতু খুব সহজেই ডিজে হওয়া যায়, তাই অনেকেই এখন এই পেশায় ঝুঁকছে। তারকা হয়ে উঠছে রাতারাতি। তবে যারা এই পেশায় ভালো করতে চায়, তাদের অবশ্যই সংগীতের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। অনুষ্ঠানের ধরন বুঝে গান বাজাতে হবে। তা ছাড়া গিয়ার আপের সময় অবশ্যই ভালো সেন্স থাকা জরুরি। এ ছাড়া এখন ডিজে বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। চাইলে যে কেউ এগুলো থেকে ডিজে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন বাইরের ডিজেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে দেশি ডিজেদের। ফলে নিজের দেশের গানগুলোও তাদের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে পারছেন তারা সহজে। নতুনদের এদিকটাতেও নজর রাখতে হবে।' ডিজে সোনিকা বলেন, 'মানুষ নির্মল আনন্দের জন্য মূলত ডিজে পার্টিতে যায়। একটি পরিবারে বিভিন্ন আনন্দ মুহূর্তে আসে। আর সেই মুহূর্তগুলো তারা বিভিন্নভাবে পালন করতে চায়। সেই কাঙ্ক্ষিত আয়োজনে একটি আধুনিক সংযোজন ডিজে। তাই এই পেশার সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে।' ঢাকাতেই বেড়ে উঠেছেন সনিকার। কিছুদিন হলো পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন। আগামীতে অডিও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সম্প্রতি তিনি বেস্ট ডিজে হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই পুরস্কার পাওয়ায় অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি আরও ভালো কাজ করার জন্য।' তার ভবিষ্যত্ স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে সনিকা মৃদু হেসে বলেন, 'আসলে স্বপ্ন তো সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায়। বর্তমানে টিভি উপস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত আছি। আর ইচ্ছা আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশি মিউজিককে উপস্থাপন করার।'
নগরজীবনের ব্যস্ততার ক্লান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইদানীং অনেকেই ছুটছেন ডিজে শোগুলোতে। ডিজেদের কারবারটা আসলে গান নিয়ে। দেশি-বিদেশি জনপ্রিয় সব গানের তালে মানুষকে দুলিয়ে দেওয়াই ডিজের আসল কাজ। আর এমনই কাজ দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন গ্যারেজের কর্ণধার ডিজে রাহাত। কী কাজ একজন ডিজের? 'যেকোনো অনুষ্ঠানে অতিথিদের গানে মাতিয়ে তোলা হলো একজন ডিজের কাজ। বিভিন্ন গান মিশিয়ে বা 'মিক্সিং' করে ডিস্ক জকি বা ডিজেরা এটি করে থাকেন। বর্তমানে বিভিন্ন কনসার্ট, অনুষ্ঠান এমনকি ঘরোয়া আয়োজনেও ডাক পড়ছে ডিজেদের। বাংলাদেশের ডিজেরা কাজ করছেন দেশের বাইরেও। ডিজে হতে চাইলে অবশ্যই মিউজিক সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা থাকতে হবে। কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অভিজ্ঞতা থাকলে তা আরও ভালো', ডিজে রাহাত বলছিলেন এ দেশে ডিজেদের সম্ভাবনার কথা। গান আর বাদ্যবাজনার প্রতি নেশা থেকেই তার এর প্রতি আগ্রহ জন্মে। বাংলাদেশে এ কালচার আসার পর সামান্য কিছু মিউজিক সংগ্রহ করে অনেকে নিজেকে ডিজে হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। অথচ একজন ডিজের 'ডিজে' সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান থাকাটা জরুরি। অনেক ডিজের তাও নেই। এ অভাববোধ থেকেই ডিজে রাহাত ২০০৭ সালে এ দেশে ডিজেদের একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গ্যারেজ সৃষ্টি করেন। ডিজে রাহাত বললেন, 'বাংলাদেশে ডিজেদের কাজের এখন প্রচুর সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই এ পেশায় সফলতা অর্জন করছেন।' এ দেশে ডিজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে খুব বেশি দিন হয়নি। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এই ধারাকে এখনও কি কেউ বাঁকা চোখে দেখেন? প্রশ্নটা লুফে নিলেন ডিজে রাহাত, 'এটা হবেই। বাংলাদেশে শুরুর দিকে যারা ব্যান্ড মিউজিক করতেন, তারাও অনেক রকম কথা শুনেছেন। নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে একটু সময় লাগেই। যারা সংস্কৃতির এই ধারা সম্পর্কে ভালো করে জানেন, আমার বিশ্বাস তারা অবশ্যই সাদরে গ্রহণ করবেন।' তিনি আরও বললেন, 'একজন ডিজের মিউজিক সম্পর্কে বিশাল ধারণা থাকতে হবে। কোনো একটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সী শ্রোতা থাকেন। মিউজিক দিয়ে তাদের সবার মন রক্ষার দায়িত্ব থাকে ডিজের ওপর। তাই কোন বয়সের শ্রোতাদের কী ধরনের মিউজিক শুনতে চায় এটা ডিজেকে বুঝতে হবে। ডিজে হতে হলে প্রথমে যে জিনিসটা দরকার তা হলো মিউজিকের ওপর ভালোবাসা। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশের জনপ্রিয় মিউজিক সংগ্রহ করে মনোযোগের সঙ্গে শোনা। তাহলেই সেই ডিজে যেকোনো অনুষ্ঠানে মিউজিক দিয়ে শ্রোতাদের মন ভরাতে পারে।'